বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা বাংলাদেশের জন্য আর গুরুতর স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে দেখা নাও দিতে পারে। কারণ দেশটি ইতোমধ্যেই করোনার অত্যন্ত সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের ব্যাপক বিস্তারের ফলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছে।
যদিও সারাদেশের মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে জানার জন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা বা পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন নেই। তবে চিকিৎসা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভাইরাসজনিত ওমিক্রন একটি প্রাকৃতিক ভ্যাকসিনের মতো কাজ করেছে। যা দেশের বেশিরভাগ জনসংখ্যাকে সংক্রামিত করার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
ইউএনবির সঙ্গে কথা বলার সময় দেশের অন্যতম শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিজন কুমার শীল, অধ্যাপক মুজাহেরুল হক এবং ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেছেন, ভাইরাসের যে কোনও নতুন রূপ এখনও ওমিক্রন সংক্রমণের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনকারী ব্যক্তিদের সংক্রামিত করতে পারে। তবে সম্ভবত এর ফলে গুরুতর কোনো অসুস্থতার সৃষ্টি হবে না।
তারা অবশ্য সতর্ক করে বলেছে, করোনার যে কোন ভ্যারিয়েন্টই টিকা না নেয়া ও জটিল শারীরিক অসুস্থতা থাকা ব্যক্তিদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
হার্ড ইমিউনিটি হল একটি ধারণা যা একটি মারাত্মক রোগের (ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল সংক্রমণ) বিস্তারের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্ষম করে তোলে। দুটি উপায়ে এটি অর্জন করা যেতে পারে-স্বাভাবিকভাবে বেশিরভাগ জনসংখ্যার সংক্রমণের মাধ্যমে এবং কৃত্রিমভাবে একটি দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: দেশে উচ্চ মাত্রার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রেখে যেতে পারে ওমিক্রন: প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের
উচ্চ মানের ইমিউনিটি
গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. বিজন কুমার শীল বলেন, ওমিক্রন যেভাবে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে তা দেশের মানুষের মধ্যে একটি উচ্চমানের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রেখে গেছে।
তিনি বলেন, ‘সুতরাং, আমি মনে করি আগামী দিনে করোনাভাইরাস দেশে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করবে না।’
তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ইতোমধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি খুব ভাল মানের হার্ড ইমিউনিটি। প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি টিকার মাধ্যমে তৈরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়ে অনেক ভালো। আমেরিকার সিডিসিও এখন স্বীকৃতি দিচ্ছে, ওমিক্রন সংক্রমণের মাধ্যমে অর্জিত প্রাকৃতিক ইমিউনিটি দুই বা তিন ডোজ টিকা দেয়ার মতোই উপকারী।’
তিনি বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের কারণে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে যাচ্ছে।
বিজন কুমার শীল আরও বলেন, ‘যেহেতু ওমিক্রন সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, খুব কম মানুষই এই ওয়েভের দ্বারা সৃষ্ট প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডির বাইরে থাকবে।’
ডা. বিজন মনে করেন বাংলাদেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ইতোমধ্যেই ওমিক্রনে সংক্রামিত হয়েছে। এবং ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সুতরাং,ভবিষ্যতে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট তীব্র জটিলতা সৃষ্টির মতো বড় কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেন, ‘ওমিক্রন প্রাকৃতিক ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করছে, কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষ এটি দ্বারা সংক্রামিত হয়েছিল।’
আরও পড়ুন: ৮৮ শতাংশ করোনা রোগী ওমিক্রনে আক্রান্ত: বিএসএমএমইউ’র জরিপ
তিনি বলেন, ‘সুতরাং, আমরা ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছি।’
তিনি বলেন, নতুন স্বাভাবিক জীবন প্রভাবিত হবে না এবং মানুষের বিদ্যমান ইমিউনিটিকে ধ্বংস করতে পারে এমন নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট না এলে, মানুষ হয়ত করোনায় আর খুব বেশি ভুগবে না।
ফ্লুর মতো হতে চলেছে
ডা. বিজন আশাবাদী যে অদূর ভবিষ্যতে করোনাভাইরাস ফ্লুর মতো হয়ে উঠবে, তবে এটি পৃথিবী থেকে নির্মূল হবে না।
তিনি বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে যদি একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট আবির্ভূত হয়, তবে এটি অন্যান্য ফ্লুগুলোর মতো উপসর্গ নিয়ে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, তবে নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো টিকা না নেয়া মানুষগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
ডা. বিজন বলেন, সারা বিশ্বে ওমিক্রন সংক্রমণের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি, করোনাকে স্থানীয় রোগে রূপান্তর শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো অস্বাভাবিক ভ্যারিয়েন্ট আবির্ভূত না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছয় মাসের মধ্যে করোনাকে স্থানীয় রোগ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।’
গবেষণা পরিচালনা
ডা. বিজন বলেন, ওমিক্রন সংক্রমণের মাধ্যমে কতজন মানুষ প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডি অর্জন করেছে তা জানতে এবং বিভিন্ন ভ্যাকসিন এবং প্রাকৃতিক সংক্রমণ দ্বারা উৎপাদিত অ্যান্টিবডিগুলোর তূলনামূলক কার্যকারিতা এবং দীর্ঘায়ু জানতে সরকারের অবিলম্বে দেশব্যাপী একটি গবেষণা পরিচালনা করা উচিত।
তিনি বলেন, এই ধরনের গবেষণা চলমান টিকাদান কর্মসূচিকে উন্নত করতে এবং টিকাগুলোর বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ওমিক্রন তরঙ্গের পরে এখন কাকে টিকা দেয়া উচিত, তা জানার জন্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন গবেষণা পরিচালনা করছে। আমাদেরও এটা করা উচিত।’
ডা. বিজনের কথার পুনরাবৃত্তি করে ডা. বে-নাজির বলেন, কোন শহর ও জেলায় মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডি বেশি এবং কোথায় কম তা জানার জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: ওমিক্রনের নতুন উপধরন আরও বেশি সংক্রামক: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদেরও জানা উচিত কোন ধরনের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আমরা যদি এটি জানতে পারি, যেখানকার মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, আমরা সেখানে কার্যক্রম চালাতে পারব। এটি গণটিকাদান কর্মসূচিকে নতুন করে সাজাতে সহায়তা করবে।
এছাড়া দেশের বাস্তব পরিস্থিতি জানতে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সরকারের উচিত করোনা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার পদক্ষেপ নেয়া।
টিকার প্রয়োজনীয়তা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ অবশ্যই ওমিক্রনের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু হার্ড ইমিউনিটি অর্জনই যথেষ্ট নয়। এখনও আমাদের শিশুসহ শতভাগ লোককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। কারণ আমরা নিশ্চিত নই যে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা টেকসই হবে বা ভবিষ্যতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব হলে এটি কতটা ভাল কাজ করবে।
ডা. হক বলেন, এটা নিশ্চিত যে করোনাভাইরাস শিগগিরই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে না, কারণ এর বিভিন্ন রূপ। এমনকি এর পুরানো ভ্যারেয়েন্টগুলোও টিকে থাকবে এবং মানুষকে সংক্রামিত করতে থাকবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সুতরাং, আমাদের হার্ড ইমিউনিটির ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। বরং ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে আমাদের টিকার ওপর নির্ভর করা উচিত।’
তিনি বলেন, এমনকি কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণের হার এক শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে। তবে নতুন কোনো ভাইরাসের উদ্ভব হলে তা যে কোনো সময় আরও বাড়তে পারে।
এই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘সুতরাং, লোকেদের মাস্ক পরা এবং ভ্যাকসিন নেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ম মেনে চলা উচিত।’
টিকা তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদ্যমান টিকার গুণমান উন্নত করতে গবেষণা চালাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন,‘আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে পারি। যা আমাদের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আজীবন সুরক্ষা দেবে। যতক্ষণ না আমরা এই ধরনের ভ্যাকসিন পাই, ততক্ষণ আমাদের টিকাদান অভিযান চালিয়ে যেতে হবে এবং সবার জন্য বুস্টার ডোজ নিশ্চিত করতে হবে।’
ডা. বিজন বলেছেন, যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং ওমিক্রনে সংক্রামিত হয়েছেন তাদের বুস্টার ডোজ প্রয়োজন নাও হতে পারে।
তার মতে, যারা ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে যাদের জটিল রোগ আছে, তারা ছাড়া সকলের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে। কারণ ওমিক্রন আগের সব ভ্যারিয়েন্টকে অতিক্রম করেছে।