বাংলাদেশ আডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের উদ্যোগে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) এসোসিয়েশনের প্রধান কার্যালয়ে, বিয়াম ফাউন্ডেশন অডিটরিয়ামে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া। মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয় সচিব ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া
আলোচক ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা পাসনা কবীর, অফিসার্স ক্লাব ঢাকার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সচিব জনাব এ. বি. এম. আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবলতার সচিব কানিজ মওলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাফিউল।
সেমিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিশেষ আলোচনায় অংশ নেন। এসময় শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান, শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি, শহীদ আবু সাঈদের ভাই মো. রমজান আলী ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুখ' ভাই নীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বক্তব্য দেন। তারা আগামী দিনের জনপ্রশাসনের কাছে জুলাই গণঅভ্যূত্থানের শহীদ পরিবার এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা তুলে ধরেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মনলয়ের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি জনাব মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সিনিয়র সচিব ও সচিবসহ সকল ব্যাচের কর্মকর্তাদের সরব ও নবম উপস্থিতি ছিল।
সেমিনারে প্রধান অতিথি প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, কোনো একটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পৃথিবীতে এত মানুষ আর কোথাও মারা যাননি। ২০১৮ সালের আন্দোলন বৃথা যায়নি। তখন শিশু কিশোরের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখয়েছিলো রাষ্ট্রপরিচালনাকারীরা ব্যর্থ। তাদের সেই বার্তা কেউ গ্রহণ করেনি। ২০২৪ সালে তারা তা বাস্তবায়ন করেছে। সিভিল সার্ভিসের সামনে দুটি পথ রয়েছে। এর যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে। সিভিল সার্ভিসকে পুরনো পথে নেওয়া যাবে না। বর্তমান সরকারের আমলে একটি মহাসুযোগ তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাকায় ‘নি হাও! চায়না-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়ন প্রদর্শনী’ সেমিনার অনুষ্ঠিত
এ সময় প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপর দলীয়করণ নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো চাপ নেই। সরকার কর্মকতাদের আইন কানুনের ভিতরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, গত সরকারের আমলে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। অভ্যূত্থানের ফলে বঞ্চিত অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। এখন রাজনীতি থেকে প্রশাসনকে দূরে রাখতে হবে। প্রশাসনে যোগ্য মানুষ থাকবেন। পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করবেন। তবে দলীয় নীতি বাস্তবায়ন করার কারণে সমস্যাটা হয়েছে। আমাদের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করতে হবে। মাঠ প্রশাসনে মনিটরিংয়ের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে জনগণ ও শহীদ পরিবারকেও যুক্ত করার দরকার। সিভিল সার্ভিসের যেমন বহু পুরোনো ইতিহাস রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সভ্যতার সূতিকাগার। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে প্রশাসনের মেলবন্ধন শক্ত করতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রাণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকারের কাজগুলো প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাস্তবায়ন করছেন। আমরা পিছনে তাকাবো না। সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে সাহস ও সততা রক্ষায় করতে হবে। কর্মকর্তাদের কেউ দুর্নীতি করলে এ দায় কেউ নেবে না। পাঠ্য বইতে শহীদ আনাসের চিঠি যুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সরকার গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করছে।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা বলেন, আমরা কাজ করতে আগ্রহী। আমাদেরকে কাজে লাগান। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আজ্ঞাবাহী হওয়ার জন্য জনগণের টাকায় আমাদের বেতন দেওয়া হয় না। জনগণের সেবার জন্যই বেতন দেওয়া হয়। আর কেউ যাতে ফ্যাসিস্ট না হতে পারে, সে জন্য আমরা কাজ করব।
অফিসার্স ক্লাব ঢাকার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সচিব জনাব এ. বি. এম. আবদুস সাত্তার বলেন, দলবাজি ও দুর্নীতি বন্ধ করা না গেলে প্রশাসন ক্যাডারের অস্তিত্ব বিলীন হবে। আগমী নির্বাচনে কেউ যাতে আমলাদের ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপকড. সৈয়দা লাসনা কবীর বলেন, বিগত আমলে রাজনীতির সঙ্গে প্রশাসনকে যুক্ত করা হয়েছিল। দুর্নীতির জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবকের স্থলে জনগণের প্রভু হয়ে গিয়েছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু কোটার জন্য হয়নি; জনগণের প্রত্যাশা পূরণে প্রশাসনকে সেবামূলক মানসম্মত ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম সততা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রশাসনের ভবিষ্যত কর্মকাণ্ড পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের সচিব ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া জনপ্রশাসনের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ, মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। আমাদের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল। ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট দেশে সরকার ছিল না। সে সময়ে প্রশাসনের সদস্যরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন: সক্ষমতা বাড়াতে এনবিআরের ডিজিটাল রূপান্তর প্রয়োজন: সেমিনারে বক্তারা
সেমিনারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের কর্মকর্তা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও দর্শনকে ধারণ করে আগামী দিনে দলীয় চিন্তা ও মতাদর্শের ঊধ্বে উঠে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্রতি হবে মর্মে সেমিনারে জোরালো প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়।