উপকূলের দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। দুশ্চিন্তায় উপকূলীয় মানুষের খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গেছে; নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে অনেকে। রাত জেগে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বেড়িবাঁধ সংস্কারের চিত্র দেখা গেছে। সাইক্লোন সেন্টারগুলোতে ইতোমধ্যে মানুষ আসা শুরু করেছে। রাতে হালকা বাতাস ও গুম গুম আওয়াজে আতঙ্ক ছড়ায়, ভোরে মেলে বৃষ্টির দেখা।
শনিবার সন্ধ্যায় মোংলা বন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণার পর খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় আতঙ্ক বাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবেলায় মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচার চালানো হয়। স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এসব এলাকায়।
দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বাঁধ ভাঙ্গায় দুর্যোগের সংকেত পেলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে উপকূলবাসী।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী এবং ওই বছরের ১০ নভেম্বর আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় বুলবুল। এ ছাড়াও ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, ২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর ওই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে।
এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। এবার উপকূলে চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল।
এরইমধ্যে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি ঢুকছে বলে জানা গেছে।
গভীর রাতে সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করে এলাকাবাসী। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিও ব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করে। যেকোনো সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা- এমন আশঙ্কায় ঘুম ছুটেছে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা; সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনির এবং বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার মানুষের।
কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বাঁধের পাশে বসবাসকারী আখতারুজ্জামান ও বিল্লাল হোসেন জানান, আইলার সময় ঘাঁটাখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপর প্রায় দুই মাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকেন। সেখান থেকে বাঁধের ওপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কথায় বাঁধের স্লোবে পুনরায় ঘর তৈরি করে বসবাস করেছেন।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: সাতক্ষীরায় সকাল থেকে বৃষ্টি, জেলেরা ফিরতে শুরু করেছেন
আইলার ১৫ বছর পরও তারা নিজ ঠিকানায় ফিরতে পারেননি। সেখানে বাঁধের পাশে প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা রিমালের সতর্ক সংকেত পেয়ে আতঙ্কে রয়েছেন।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট ও খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত এলাকার বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা শাহিন আলম জানান, ইউনিয়নের অধিকাংশ বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। কয়েকদিন আগে এলাকার একটি বেড়িবাঁধে ধস নামে। এখন রিমাল আসার খবরে তারা খুবই আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আওতায় ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গাবুরায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
‘কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে সেজন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিভাগ-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: চট্টগ্রামে ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্র ও ২৯০ মেডিকেল টিমের প্রস্তুতি
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষের পাশাপাশি ৫৬০টি গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।
কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।