যে কালরাতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, অনিশ্চয়তা আঁকড়ে ধরেছিল শহরকে এবং আপাতদৃষ্টিতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল দেশের নেতৃত্ব, তখনও নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি কর্নেল জামিল। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহসহ সিনিয়র অফিসারদের বলেছিলেন সেখানে সেনা পাঠানোর কথা। এরপরই তিনি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে (পিজিআর) নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য এবং তৎক্ষণাৎ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের দিকে রওনা হন।
এর আগে শান্তভাবে নিজের সার্ভিস রিভলবারটি খাপে রেখে কর্নেল জামিল তার স্ত্রী-সন্তানদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিপদ। কীভাবে আমি না গিয়ে পারি?’
জিপে চড়ার আগে স্ত্রীর প্রতি তার শেষ কথা ছিল, ‘আমার কন্যাদের খেয়াল রেখো।’
সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে কর্নেল জামিলকে থামায় পিজিআর কনভয়। কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, সামনে সেনা ইউনিট রয়েছে এবং গোলাগুলি চলছে। সামনে এগোনোর জন্য তিনি সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন।
সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি জিপে চেপে বসেন এবং নিজেই গাড়ি চালিয়ে ৩২ নম্বর রোডে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন।
জিপে বসার পরপরই গুলি করা হয় সাহসী এই দেশপ্রেমিককে। গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়েন তিনি। শাহাদতবরণ করেন কর্নেল জামিল, যিনি অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন। নীতি ও কর্তব্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য কর্নেল জামিলকে দান করেছে শহীদের মর্যাদা। যে রাতে অনেক সাহসী মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন, সেই রাতে নিজের কর্তব্যবোধে অটল ছিলেন কর্নেল জামিল। সাহসিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তার দায়িত্বশীলতার।
বঙ্গবন্ধুর সাথে কর্নেল জামিল (বামে)
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত জামিলের পরিবার জানত না যে কী ঘটেছে তার ভাগ্যে।
এপর জেনারেল সফিউল্লাহর ফোন আসে, যাকে ভোরে কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন। ফোন ধরেন কর্নেল জামিলের স্ত্রী এবং জেনারেল সফিউল্লাহর গলা ধরে আসছিল মিসেস জামিলকে তার স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ দিতে। সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিককে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কর্নেল জামিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে জিম্মি ছিলেন। কিন্তু সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্নেল জামিলের সততা এবং পেশাদারিত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের সামরিক সচিব হিসেবে নিযুক্ত করেন।
জেনারেল শফিউল্লাহ, যিনি জামিলের সাথে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, অনেক বছর পর বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘সেই দিনগুলোতে জামিল ভাই, আমি এবং কিছু বাঙালি অফিসার পাকিস্তানে ছিলাম এবং আমাদের ভেতর নিয়মিত যোগাযোগ হতো। সে সময় বাঙালি জাতীয়বাদ ছিল উদীয়মান পর্যায়ে।’
‘পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখেছি সেনাবাহিনীতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব কতো কম ছিল। যখনই আমাদের সাক্ষাৎ হতো আমরা এ বিষয়ে কথা বলতাম। আমাদের মধ্যে জামিল ভাইয়ের জাতীয়তাবোধ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মাঝে মাঝে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়তেন,’ যোগ করেন তিনি।
২০১০ সালে কর্নেল জামিলকে মরণোত্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবি দেয়া হয় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচানোর জন্য যে অসীম সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্য অনেক দেরিতে এ সম্মাননা দেয়া হয় কর্নেল জামিলকে, কারণ এই দেশে ত্যাগ ও সাহসিকতাকেও দেখা হয় পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টিতে। বাঙালি জাতির জন্য কর্নেল জামিলকে স্মরণের এ এক বিলম্বিত ক্ষণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ মহান বীরের বিরল আত্মত্যাগের ওপর আরও নিবিড় নজর দেয়ার সময় এসেছে।
কর্নেল জামিলের জ্যেষ্ঠ কন্যা তাহমিনা এনায়েত বলেন, ‘তার আত্মা শান্তিতে থাকবে এবং আমিও মারা যাব। আমার বাবা একজন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। আমি গর্বিত, আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।’
কর্নেল জামিলের আত্মদান তাকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি দেশের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং কর্তব্য পালনের জন্য হাসিমুখে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। জাতি যখন দাঁড়িয়ে ছিল অনিশ্চয়তার বাঁকে, কর্নেল জামিল তখন দেখিয়েছেন নৈতিক সাহসিকতা; যা তাকে মহান এবং সত্যিকারের একজন নায়ক-এ পরিণত করেছে।
এনায়েতুল্লাহ খান: এডিটর-ইন-চিফ, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) এবং ঢাকা ক্যুরিয়ার।