রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন হওয়ায় খুবই কঠিন সময় পার করছে শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। রমজানে তাদের মাসিক ব্যয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ।
এমন অনেকেই আছেন যাদের বাসা সুপারশপগুলোর আশেপাশে, অথচ তারা এখন স্থানীয় কাঁচাবাজার থেকে বাজার করছেন। আর মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি কারোর রউপর ভরসা না করে নিজেই বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করছেন, যাতে কিছুটা হলেও সাশ্রয় হয়।
তাদের একজন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিজীবী কাজী শরিফুল হক ইউএনবিকে বলেন, রমজানে ইফতার ও সেহরির সময় যে খাবার খাওয়া হয়, তাতে অন্য সময়ের থেকে মাসে খাবার খরচ বেশি হয়। এসময় সাধারণত ফল, গরুর মাংস ও খাসির মাংসের মতো কিছু জিনিসের ব্যবহার কমে যায়।
ইউএনবি শরিফুলের সঙ্গে রাজধানীর প্রধান কাঁচাবাজার কাওরানবাজারে কথা হয় ইউএনবির। যেখানে তিনি গিয়েছিলেন পুরো সপ্তাহের বাজার করতে। একটি কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ ও মুরগি।
তিনি বলেন, তার অভিজ্ঞতায় বেশিরভাগ পণ্যের দাম কেজিপ্রতি ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রমজান মাসের শুরুতেই মাছের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, মুরগির মাংস ১৫ থেকে ২০ টাকা, ছোলা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সরকার নির্ধারিত মূল্যে খেজুর পাওয়া যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, আপেল, মাল্টাসহ কিছু ফল প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে।
আরও পড়ুন: রমজানে ইফতার পার্টি না করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান: প্রধানমন্ত্রী
শরিফুল জানান, চাল ও ভোজ্যতেলের দাম আপাতত স্থিতিশীল। তবে সংসার খরচ শুধু বাজারের খরচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওষুধ (স্বাস্থ্য), পানির বিল, গ্যাসের বিল, বিদ্যুৎ, বাড়িভাড়াসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন বিল ও দ্রব্যমূল্য শহরের মধ্যবিত্তকে চেপে ধরছে, বিশেষত শরিফুলের মতো প্রান্তিক অবস্থানের মানুষকে। সর্বশেষ দুই বছর আগে তার কর্মস্থলে বেতন বাড়ানো হয়েছিল এবং এই দুই বছরে দেশে মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে। এমনকি তিনি যে সংস্থায় কাজ করেছিলেন সেই সংস্থাটিও এই দুই বছরে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং এ কারণে তিনি আর্থিক চাপে হতাশ হয়ে পড়েন।
তবুও ২-৩ বছর আগে একই লোকদের সঙ্গে কাটানো ভালো সময় শরিফুলকে এখনো আশাবাদী করে তোলে।
২০২১ সালে ঢাকার ফার্মগেটে চার সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের পাশাপাশি গ্রামে বসবাসরত বাবা-মায়ের খরচও দিয়েছেন তিনি। তারপরও প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পেরেছেন শরিফুল। ‘আর এখন আমাকে আমার আগের সঞ্চয় দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হচ্ছে’- ক্ষোভের সঙ্গে বলেন শরিফুল।
ইদানিং রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে শরিফুলের মতো অবস্থা অধিকাংশ ক্রেতাদের।
২০০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে 'স্কুইজড মিডল' শব্দটি চয়ন করেছিলেন।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ২০১১ সালে এটিকে তাদের 'ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার' হিসেবে বিবেচনা করে। এটির সংজ্ঞায় বলা হয়, "এটি এমন একটি শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত সমাজ, যাদের আয় নিম্ন বা মধ্যম স্তরের। এরা মুদ্রাস্ফীতি, মজুরি হিমায়িত ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় খরচ কমাতে বাধ্য হয়।”
শরিফুল ও তার আশেপাশের সবার অবস্থা এরকম।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ইউএনবিকে বলেন, মুদ্রাস্ফীতি ও এলোমেলোভাবে বিনিময় হারের ওঠানামা (আমদানি পণ্যের দামকে প্রভাবিত করে) শহরাঞ্চলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ শহুরে মানুষ সরবরাহ চেইনের উপর নির্ভর করছে।
তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে একটি পরিবারের ভোগ করা পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় নিজের জমিতে, যা শহরে হয় না। মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগই এমনকি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নগর জীবনকে আরও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
কাওরানবাজারের শরিফুলসহ অন্যদের একই রকম অবস্থার সত্যতা নিশ্চিত করে ফাহমিদা বলেন, শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম নয়- স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয় ও নানা ধরনের (ইউটিলিটি) বিলও বেড়েছে।
ফাহমিদা বলেন, ‘কোভিডের প্রাদুর্ভাব (২০২০-২০২২) কমে যাওয়ার পর পরিবারের আয়, মূলত বেতন বাড়েনি। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে পড়েছেন চাকরিজীবীরা।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া সময়সীমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০২৩ সালের নভেম্বরে টানা ২২তম মাস বাংলাদেশে গড় মজুরি প্রবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির হারের অনেক নিচে রয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আমদানি হোক বা দেশে উৎপাদিত হোক সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, চাকরিজীবীদের আয় না বাড়লেও অন্যদের পাশাপাশি তাদের ব্যয়ও বেড়েছে, তবে এটি নির্দিষ্ট আয়ের গোষ্ঠীর জন্য একটি বিশেষ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, যদি 'যৌক্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে' দাম বাড়ানো হয় অর্থাৎ বাজারের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে চলা, তাহলে এই বোঝা নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকবে। কিন্তু যখন স্বেচ্ছাচারিতা করে, তখন জনগণের পক্ষে এটি খুব কঠিন হয়ে যায়।
এমনটি এটি ঘটছে কি না সেদিকে কর্তৃপক্ষকে আরও মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, কারণ দেশে মূল্যবৃদ্ধি, মজুতদারি ইত্যাদির বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে আইন রয়েছে।
যেখানেই অনিয়ম পাওয়া যায়, সেখানে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা, বাজারে স্থিতিশীলতা আনার আহ্বান জানান ক্যাব সভাপতি।
আরও পড়ুন: রমজানে ২৫ মার্চ পর্যন্ত খোলা থাকবে স্কুল: শিক্ষা মন্ত্রণালয়