দেশের কয়েকটি জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও সম্প্রদায়কে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করেছে সরকার। খুব শিগগিরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করবে সরকার।
ইউএনবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কী ধরনের হবে, সেটি ঠিক করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ শুরু হয়েছে।’
উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা বন্যার ত্রাণ পর্যায়টা অতিক্রম করে পুনর্বাসন পর্যায়ের দিকে যাচ্ছি।এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের বিষয়ে কাজ খুব দ্রুত চলছে।'
উপদেষ্টা আরও বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। বন্যার পানি সম্পূর্ণভাবে নামার পর পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করব। কেউ যেন বাদ না পড়েন সে বিষয়ে আমরা লক্ষ্য রাখব।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে পারব। এ বিষয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমরা চাই সঠিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পুনর্বাসন করতে। একটি লোকও তা থেকে বঞ্চিত হবে না।
উপদেষ্টা আরও বলেন, 'ডি-ফরমের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য দেওয়ার একটি সময় রয়েছে। সেটি তিন সপ্তাহের মধ্যে দিতে হয়। আমরা সেটি এক সপ্তাহের মধ্যে করতে বলেছি, যত দ্রুত করা যায়।'
তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনে আমি যখন কথা বলেছি, তাদের দৃঢ়তা দেখেছি। তারা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ:
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ও মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্যোগ ব্যস্থাপনা অধিদপ্তর এবং বন্যাকবলিত সব এলাকার পিআইওদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক ও ইউএনও ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন।
এছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণলায়ও কাজ করছে, যেমন কৃষি, মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি, ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের অনুধান:
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে। কৃষকদের কৃষি উপকরণসহ যা যা প্রয়োজন তা দেওয়া হবে।
বাড়ি নির্মাণ:
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নিরূপণ করে যার বাড়ি দরকার তাকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। বসবাস করার উপযোগী বাড়ি তৈরি করা হবে। পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতাও করা হবে।
পোল্টি ফার্ম ও গবাদি পশুর খামারিকে সহযোগিতা—
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যাদের পোল্টি ফার্ম ও গবাদি পশুর খামার ছিল তাদের খামার তৈরি করতে আর্থিক সহযোগিতাসহ খামারে হাঁস মুরগি ও গবাদি পশু দেওয়া হবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ:
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাদের দোকানপাট ছিল, ব্যবসা করতেন, তাদের পুনরায় ব্যবসা চালু করতে আর্থিক সহযোগিতাসহ দোকান তৈরি করে দেওয়া হবে।
বিভিন্ন রোগের সুচিকৎসা
বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই হতে পারে। তাদের সুচিকৎসাসহ ওষুধের ব্যবস্থা করা হবে।
বাচ্চাদের কাউন্সিলিং করা হবে
বন্যাকবলিত এলাকায় অনেক বাচ্চার মধ্যে একটা ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। সেটি দূর করতে কাউন্সিলিং করা হবে। প্রত্যকের পড়াশুনার জন্য বই খাতাসহ সব সহযোগিতা করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টার অনুদান চেক গ্রহণ
সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে অনুদানের চেক গ্ৰহণ করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা। প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অনুদানের চেক গ্রহণ করা হচ্ছে।
দাতা সংস্থাগুলো পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস
গতকাল সোমবার (৩ সেপ্টেম্বরল) সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের সমন্বয়ক, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইওএম চিফ অব মিশন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, ডব্লিউএফপির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ, ইউএনআরসিও হিউম্যান্টেরিয়ান অ্যাফেয়ার অ্যাডভাইজারের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর দাতা সংস্থাগুলো পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
উপদেষ্টা বলেন, ‘বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে এসেছে। আমি আজকে ( সোমবার) ইউএন (জাতিসংঘ) বডির নানা রকমের আটটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সভা করেছি। তারা এই (পুনর্বাসন) কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।'
তিনি বলেন, 'তারা বাংলাদেশের মানুষের অপার স্বেচ্ছাসেবা, অভূতপূর্ব সহযোগিতার জন্য প্রশংসা করেছেন। ত্রাণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনী ও জনগণের যে উদ্দীপনা তারা দেখেছেন, ত্যাগ তারা দেখেছেন- এটার প্রশংসা করেছেন।'
তিনি বলেন, 'মাঠ পর্যায় থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর কোন কোন বিষয়ে তারা সহযোগিতা দিতে পারেন সেটা আমরা নির্ণয় করে দিলে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আশাবাদী যে, আমরা যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় দুর্যোগ অতিক্রম করতে পেরেছি, আমরা ভবিষ্যতে পুনর্বাসন কর্মসূচিও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারব।'
বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, বন্যায় মৃতের লোকসংখ্যা ৭১ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪৫ জন, নারী ৭ জন ও শিশু ১৯ জন। নিহতদের মধ্যে কুমিল্লায় ১৯, ফেনীতে ২৮, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ১১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১, কক্সবাজারে ৩ ও মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন। এখনও মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
এখনো ৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মোট লোকসংখ্যা ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২ জন।
সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ নিজের বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। এখনও ৩ হাজার ৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন লোক এবং ৩১ হাজার ২০৩টি গবাদি পশু রয়েছে।