ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর থেকে সুন্দরবন, বেড়িবাঁধ থেকে মৎস্যঘের- সবখানেই রিমালের ক্ষতচিহ্ন।
ঘূর্ণিঝড়ে এক নারী মারা গেছেন। জেলায় মানুষের ৪৫ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশপাশি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে জলোচ্ছ্বাসে বণ্যপ্রাণীগুলো আবাস্থল হারিয়ে ফেলেছে।
গোটা জেলায় ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের সবকটিতেই রিমালের ক্ষত রয়েছে। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ কোটি কোটি টাকা। জেলায় ৫ লাখ মানুষ রিমালের তাণ্ডবে আক্রান্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন জানান।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছে, রিমালের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। দুর্গত মানুষরা বলছে, রিমাল দীর্ঘ সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সহায়-সম্পদ। রিমালের মতো দীর্ঘ সময়ের ঝড় তারা আগে দেখেননি।
জানা গেছে, রবিবার (২৬ মে) দুপুরের জোয়ারে নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ থেকে ১০ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। জোয়ারের সময় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। বনের মধ্যে দিয়ে ৭ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। রিমাল প্রথমে সুন্দরবনে আঘাত হানে। দীর্ঘ সময় ধরে সুন্দরবনে তাণ্ডব চালিয়ে রিমাল উপকূলে আঘাত হানে।
জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী তার আবাসস্থল হারিয়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করে। পানিতে বেশকিছু হরিণ ভেসে গেছে। আবার পানিতে ডুবে হরিণ মারা গেছে। লবণ পানি প্রবেশ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ৮০টি মিষ্টি পানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে ও উপড়ে পড়েছে।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, রিমালের তাণ্ডবে বাগেরহাট জেলায় ৪৫ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ এবং ৩৫ হাজার বাড়িঘরের আংশিক ক্ষতি হয়। শরণখোলায় সোমবার বিকালে গাছচাপায় ফজিলা বেগম (৫৫) নামে এক নারী নিহত হন। রিমালের আঘাতে জেলায় ৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে ছিল।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: ১ কোটি ৭২ লাখ গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎবিহীন
মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের সবকটিতেই রিমালের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ে জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেয়। সেই সঙ্গে মানুষ তাদের গবাদি পশুও আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসে। আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষকে শুকনা খাবারের পাশাপাশি খিচুড়ি এবং নানা ধরনের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলায় তাৎক্ষণিকভাবে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ১৯ লাখ টাকা, ১০ হাজার ১০০ কেজি চিড়া, ৭০০ কেজি গুড়, ২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট, ৮৪০ লিটার পানি দেওয়া হয়। প্রাথমিক তালিকায় ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩৫ হাজার বাড়িঘরের আংশিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। জেলায় মোট ৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরিতে কাজ চলছে বলে জেলা প্রশাসক জানান।
সুন্দরবন
রিমারে তাণ্ডবে বিশ্ব ঐহিত্য সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়ে ফেলে। পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭টি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া মৃত অবস্থায় ৩৯টি হরিণ একটি শুকর উদ্ধার করে বন বিভাগের সদস্যরা।
ঝড়ে বনের বিভিন্ন অংশে গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবণ পানি ঢুকে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী, বনের স্টাফ এবং বনজীবীদের জন্য খনন করা ৮০টি মিষ্টি পানির পুকুর ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের বিভিন্ন কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবণ পানি দীর্ঘ সময় বনের মধ্যে জমে থাকায় বন্যপ্রাণীর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, রিমালের তাণ্ডবে সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছপালার পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর অনেক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আবাস্থল হারিয়ে ফেলে। জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া ৩৯টি হরিণ এবং একটি শুকর উদ্ধার করা হয়। ভেসে যাওয়ার সময় ১৭টি হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে। রিমালের তাণ্ডবে বন বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনার সাড়ে ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বনপ্রাণী ও বনের গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি সরজমিনে দেখে তালিকা করার জন্য খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো এবং সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বনের ওই কর্মকর্তারা বুধবার সুন্দরবন সরজিমেন পরিদর্শন করছেন। তালিকা পাওয়ার পর সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: খুলনায় ১৭ হাজার ৭৯৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত