ক্রেমলিনের প্রধান শত্রু অ্যালেক্সেই নাভালনির মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা ক্ষোভের প্রতি কান দিচ্ছেন না। কারণ তিনি আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তার ২৪ বছরের শাসনের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং রাশিয়াজুড়ে পুলিশ যেকোনো প্রতিবাদ প্রচেষ্টা দমন করছে।
নাভালনির মৃত্যু ও ইউক্রেনে ক্রেমলিনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহায়তা কংগ্রেসে আটকে রয়েছে এবং ইউরোপে ন্যাটো মিত্ররা শূন্যস্থান পূরণের জন্য লড়াই করছে। তাই অনেকে ভাবছেন যে পশ্চিমারা ক্রেমলিনের নির্মম নেতাকে থামাতে আসলে কী করতে পারবে? কারণ এর আগে একাধিক বার তাকে শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
লন্ডনভিত্তিক মায়াক ইন্টেলিজেন্স কনসালটেন্সি ফার্মের প্রধান মার্ক গালিওটি ইউটিউব মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো বড় মূল্য নেই।’ কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলোর একটি দেশ হলো রাশিয়া।
গালিওত্তি বলেন, এর পরিবর্তে পশ্চিমাদের উচিত নাভালনির মিত্রদের সঙ্গে কাজ করা এবং ক্রেমলিনের প্রচারণা মোকাবিলায় সাধারণ রুশদের তথ্য চ্যানেলে প্রবেশাধিকার পেতে সহায়তা করা।
নাভালনির মৃত্যুকে পুতিনের 'হাইব্রিড কর্তৃত্ববাদ' থেকে 'নৃশংস ও ধ্বংসাত্মক স্বৈরতন্ত্র'তে রূপান্তরের আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন গালিওত্তি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন জোরদার করার জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেখানে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী চার মাসের ভয়াবহ লড়াইয়ের পরে ইউক্রেনীয় সেনাদের মূল পূর্বাঞ্চলীয় শক্ত ঘাঁটি আভদিভকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। মিত্ররা রাশিয়ার কাছে যুদ্ধের ব্যয় বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেছে যাতে পুতিনকে পিছু হটতে বাধ্য করা যায়।
তবে ৭১ বছর বয়সী নেতা তার কোনো অর্জন ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে গত সপ্তাহে ফক্স নিউজের সাবেক উপস্থাপক টাকার কার্লসনের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পশ্চিমারা তার শর্তে 'আজ হোক বা কাল হোক' কোনো না কোনো চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হবে।
বেলারুশে সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ও লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া ও ইউরেশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো নাইজেল গোল্ড-ডেভিস বলেন, নাভালনির মৃত্যু পুতিনের 'সম্পূর্ণ নির্মমতা ও অবজ্ঞা... পশ্চিমা ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিপ্রেক্ষিতে।’
শুক্রবার মিউনিখে এক নিরাপত্তা সম্মেলনে পশ্চিমা নেতারা জড়ো হওয়ার পর নাভালনির মৃত্যুর ঘোষণা দেয় রাশিয়া।
গোল্ড-ডেভিস বলেন, পুতিন ‘পশ্চিমাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। আমরা যখন (ইউক্রেন) যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আছি, তিনি আবারও পশ্চিমা সংকল্পের পরীক্ষা নিচ্ছেন।’
গোল্ড-ডেভিস বলেন, নাভালনির মৃত্যু কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্য সহায়তার বিরোধিতা করা মার্কিন রিপাবলিকানদের জন্য "জেগে ওঠার আহ্বান" হিসেবে কাজ করা উচিত। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্রদের ইউক্রেনকে তাদের সহায়তা জোরদার করতে উৎসাহিত করা উচিত।
তিনি বলেন, 'শেষ পর্যন্ত এটা নির্ভর করছে পশ্চিমারা কী শিক্ষা নেয় তার ওপর।’
কিন্তু নাভালনির মৃত্যু শুক্রবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারকে ইউক্রেনের জন্য প্রস্তাবিত ৬১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজের প্রতিশ্রুতি দিতে উদ্বুদ্ধ করেনি, যা ইউক্রেনের বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, সোভিয়েত একনায়ক জোসেফ স্ট্যালিনের পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা রুশ নেতা পুতিন ক্রেমলিনবান্ধব দলগুলোর মনোনীত তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। আরও ছয় বছরের জন্য ক্ষমতায় আসছেন তিনি। উদারপন্থী রাজনীতিবিদ বরিস নাদেজদিন, যিনি ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানকে তার প্রধান নির্বাচনি স্লোগান বানিয়েছিলেন, নির্বাচনি কর্মকর্তারা তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করেছিলেন।
‘নির্বাচনে পুতিনের জয় নিয়ে সংশয় না থাকলেও নাভালনির মৃত্যু প্রমাণ করে 'তিনি নাভালনিকে কতটা হুমকি হিসেবে দেখছেন', বলেন গোল্ড-ডেভিস।
তিনি আরও বলেন, ‘ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত যেভাবে নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছে তাতে বোঝা যায় যে তারা আত্মবিশ্বাসী নয়। এমনকি কারাগার থেকেও নাভালনি তার কণ্ঠস্বর বের করতে সক্ষম হয়েছেন।’
গোল্ড-ডেভিস বলেন, ১৫-১৭ মার্চের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে নাভালনির মৃত্যু সম্ভবত ভোটের আগে 'রাশিয়ার বিরোধীদের যেকোনো চিহ্নকে মুছে ফেলা ও চূর্ণ করার চূড়ান্ত কাজ' হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, আগামী মাসে নিশ্চিত বিজয় সত্ত্বেও পুতিন এখনও নির্বাচনে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করছেন এবং নাভালনিকে 'জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার জন্য পশ্চিমাদের দ্বারা চালিত প্রতিপক্ষ' হিসেবে দেখেন।
একটি মন্তব্যে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে পশ্চিমারা স্থিতিশীলতা হ্রাস করতে এবং তার প্রচারের রাজনৈতিক ক্ষতি করতে এই মুহূর্তটি ব্যবহার করবে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘এটি তাকে যেকোনো প্রতিকূল প্রকাশের বিরুদ্ধে আরও কঠোর, আরও দমনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বাধ্য করবে, যা তিনি এসব হস্তক্ষেপের বহিরাগত প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। এটি বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে।’
৪৭ বছর বয়সি নাভালনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতিনের জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ২০১১-২০১২ সালে মস্কোতে পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। সরকারের দুর্নীতি উন্মোচন করার জন্য সফল প্রচার চালিয়েছিলেন।
গালেওত্তি বলেন, অনেক রুশ নাগরিকের কাছে নাভালনি ছিলেন আশার প্রতীক। এমনকি প্রত্যন্ত আর্কটিক কারাগার থেকেও “ভবিষ্যতের সুন্দর রাশিয়ার” একটি দর্শন পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাশিয়ানদের প্রতি ক্রেমলিনের বার্তা "কেবল বেঁচে থাকুন, কেবল আপনার মাথা নিচু রাখুন” অগ্রাহ্য করে এটি একটি স্লোগান ছিল।
২০২০ সালে নাভালনি সাইবেরিয়ায় নার্ভ এজেন্টের বিষক্রিয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন, যার জন্য তিনি ক্রেমলিনকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জার্মানিতে সুস্থ হয়ে উঠলেও ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফেরার পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তিনি কারাগারে ছিলেন, চরমপন্থার অভিযোগে তিনবার দোষী সাব্যস্ত হন এবং ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেওেয়া হয় তাকে।
নাভালনির মৃত্যুর বিষয়ে পুতিন কোনো মন্তব্য করেননি এবং ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ক্রেমলিনকে দায়ী করে পশ্চিমা নেতাদের বিবৃতিকে 'জঘন্য ও অগ্রহণযোগ্য' বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কিন্তু পশ্চিমা নেতারা ক্রেমলিনের এ ধরনের যেকোনো মন্তব্যকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। যেমন সন্দেহের চোখে দেখছেন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সৈন্যদের সংক্ষিপ্ত বিদ্রোহের দুই মাস পর ভাড়াটে সেনাপ্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার বিষয়টি। গত আগস্টের এই দুর্ঘটনাকে ব্যাপকভাবে বিদ্রোহের জন্য ক্রেমলিনের প্রতিশোধ হিসেবে দেখা হয়েছিল। ২০০০ সালে তার প্রথম নির্বাচনের পর থেকে পুতিনের শাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল এটি।
গোল্ড-ডেভিস বলেন, ‘প্রিগোজিনের মৃত্যুর মতোই নাভালনির মৃত্যুও প্রমাণ করে পুতিন কত নির্মম।’