বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরির বাজারে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পাওয়াটাই দুষ্কর। শত কষ্টের পর একটা ইন্টারভিউয়ের ডাক পাওয়ার পরই সব কাজ শেষ নয়। সেই ইন্টারভিউ সফল করতেও ইন্টারভিউয়ের ইমেইল পাওয়ার পর থেকে চূড়ান্ত ভাইভা পর্যন্ত প্রতিটি ক্রিয়াকলাপে যোগ্যতার প্রমাণ দেখাতে হয়। চাকরি দাতাদের সঙ্গে অতিবাহিত ১০-১৫ মিনিট সময়ই নির্ধারণ করে দিতে পারে একজন চাকরিপ্রার্থীর বাকি জীবনকে। তাই এই ক্ষুদ্র সময়টুকু প্রত্যেকের জন্যই বেশ কঠিন সময়। তবে কিছু বিষয়ে পূর্বপ্রস্তুতি এই জটিলতাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে। আজকের ফিচারে সফল ইন্টারভিউয়ের কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ইন্টারভিউতে সফল হওয়ার ১০টি টিপস
প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা নেয়া
ইন্টারভিউয়ের সময় প্রত্যেক নিয়োগকর্তাই তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে থাকেন। নতুনগুলোর ক্ষেত্রে নিদেনপক্ষে প্রাসঙ্গিক ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। তাই একজন চাকরিপ্রার্থীর প্রথম কাজ হলো প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করা। অনেক সময় সরাসরি প্রশ্ন না করে পরোক্ষভাবে জেনে নেয়া হয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে প্রার্থী কতটুকু জানেন। তাই যে কোনো অবস্থায় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদর্শন করা উচিত। এর জন্য প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে তার ইতিহাস, মিশন-ভিশন, কর্মী, সংস্কৃতি এবং সাম্প্রতিক সাফল্যের তথ্যগুলো খুঁজতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ, গ্রুপ এবং ব্লগ নিয়ে পড়াশোনা করা একটি সময়োপযোগী বিষয়।
আরও পড়ুন: ব্যাংকে চাকরি: সাউথইস্ট ব্যাংকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি , লাগবে না অভিজ্ঞতা, বেতন ৩৬,০০০
চাকরি বিজ্ঞপ্তি ভালো করে পড়ে নেয়া
ইন্টারভিউ দিতে আসার সময় প্রায় ৯০ শতাংশ প্রার্থী চাকরির বিবরণ ভালো করে পড়েন না। আবেদনকারীরা তাদের জীবনবৃত্তান্তসহ আবেদন জমা দেয়ার আগে বিবরণগুলো পড়তে সর্বোচ্চ ৩০ সেকেন্ড বা তার কম সময় ব্যয় করেন। শুধুমাত্র শিরোনাম এবং কয়েকটি বুলেট পয়েন্ট দেখেই তারা চাকরিতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। ফলে একটি চাকরিতে অনেক অনপোযুক্ত আবেদন পড়ে। এতে কোনভাবে ইন্টারভিউ মেলাতে পারলেও তাতে ভালো পারফরমেন্স করা যায় না।
চাকরিতে আসলে কী কাজ করতে হবে, আবেদন প্রক্রিয়া চলাকালীন কোন নির্দেশাবলী আছে কিনা এই বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিজ্ঞপ্তি থেকে বের করতে হবে। এর জন্য পুরো বিজ্ঞপ্তিটি মনোযোগ দিয়ে একাধিকার পড়তে হবে। যাচাই করে দেখতে হবে যে, প্রার্থীর পারদর্শীতার সঙ্গে চাকরির বিবরণ একীভূত কিনা।
ইন্টারভিউয়ের জন্য দরকারি জিনিস আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা
ইন্টরভিউয়ের জন্য উপযুক্ত পোশাক, জীবনবৃত্তান্তের অতিরিক্ত কপি, একটি নোটপ্যাড এবং একটি কলম আগেভাগেই প্রস্তুত করে রাখতে হবে। সাক্ষাৎকারের দিন যেন এসব জিনিস নিয়ে বেশি সময় নিয়ে ভাবতে না হয়। এর জন্য তিন দিন আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে রাখতে হবে। একটি পলিশ করা জুতা, মার্জিতভাবে চুল আঁচড়ানো, ক্লিন শেভ অথবা দাড়ি থাকলে তা ট্রিম করে নেয়া, কোন যানবাহন ব্যবহার করা হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো এই পরিকল্পনার অন্তভুর্ক্ত।
আরও পড়ুন: চাকরির সিভি ও পোর্টফোলিও তৈরির প্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইট
ইন্টারভিউ বোর্ডে রিজুমি ছাড়াও আরও কিছু নিয়ে যাবার নির্দেশাবলী আছে কিনা তার জন্য বিজ্ঞপ্তি ভালো করে পড়ে নিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেহেতু ফোন কলের মাধ্যমে ইন্টারভিউয়ের খবর জানানো হয়, তাই তখনই ইন্টারভিউ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জেনে নেয়া উচিত। অনলাইন ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রে কম্পিউটার, ওয়েবক্যাম, হেডফোন, ভিডিও কনফারেন্স অ্যাপসহ যাবতীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ঠিক আছে কিনা তা ভালো করে চেক করে নিতে হবে।
প্রথম দৃষ্টেই নিজের ব্যাপারে একটি ভালো ধারণা দেয়া
সময়ানুবর্তীতা, পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন পোশাক এবং চেহারায় সৌন্দর্য্য ও প্রাণবন্ত ভাব প্রথম দৃষ্টেই ভালো ধারণা দিতে পারে। এতে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির তৈরি হবে যেখানে নিয়োগকর্তা ভাববেন যে এই প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাসহ কাস্টমারদের সামনে হাজির করা যাবে। সম্বোধনের মুহূর্তে উষ্ণ করমর্দন এবং বিনয়ী ভাব প্রদর্শন করতে হবে। শুভেচ্ছা জানানোর সময় চোখের দিকে তাকানো জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে আত্মবিশ্বাস যেন অহংকারে পরিণত না হয়।
সাক্ষাৎকারের ঠিক আগে ধূমপান বা কোনো কিছু খাওয়া পরিহার করা উচিত। তার বদলে মুখে মিন্ট ক্যান্ডি বা চুইঙ্গাম রাখা যেতে পারে এবং তা যেন অবশ্যই ইন্টারভিউয়ের প্রবেশের আগে মুখ থেকে ফেলে দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: অনলাইনে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে প্রয়োজনীয় পাঁচ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম
ইন্টারভিউয়ের কতিপয় সাধারণ প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত রাখা
নিজের জন্য উপযুক্ত কিছু সাধারণ প্রশ্ন-উত্তর আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখতে হবে। এর জন্য গুগল বা ইউটিউবে পড়াশোনা করা যেতে পারে। নিজের পরিচয়, কেন চাকরিতে নেয়া হবে, কয়েকটি দুর্বলতা এবং শক্তি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর কৌশলপূর্ণ উত্তর রেডি করতে হবে।
তাছাড়া যে কাজগুলো করতে হবে অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নগুলো নেট থেকে বের করে তার ওপর প্রস্তুতি নিতে হবে। অতঃপর টেপ রেকর্ডার চালিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর বলার অনুশীলন করে নিজেকে ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে। এই কাজটি ইন্টারভিউ বোর্ডে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে।
কথা বলায় শান্তভাব, সুনির্দিষ্টতা ও ইতিবাচকতা বজায় রাখা
ইন্টারভিউ চলাকালীন উত্তর দেয়ার মান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যখন কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে সে বিষয়ে প্রার্থী অন্ধকারে থাকে তখন তার উত্তরগুলোতে অশান্ত ভাব বিরাজ করে। এই সময় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ হতাশা বিবর্জিত হওয়া বাঞ্চনীয়। তাই আগে থেকেই হতাশা থেকে মনকে দূরে রাখার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আশেপাশের চাকরিপ্রার্থীদের অতিরঞ্জিত কোন কথায় কান দেয়া যাবে না।
আরও পড়ুন: চাকরি প্রার্থীদের সফল সিভি তৈরির কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
যানযটের কথা ভেবে হাতে বেশ সময় নিয়েই বাসা থেকে রওনা দিতে হবে। নতুবা যানযটের কারণে ইন্টারভিউতে পৌঁছতে দেরি হলে কথা বলাতে অস্থিরতা চলে আসবে। উত্তরগুলো সংক্ষিপ্ত এবং প্রাসঙ্গিক হওয়া উচিত। স্বল্প কথার মধ্যেই দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা প্রদর্শন করার চেষ্টা করতে হবে। প্রাক্তন প্রতিষ্ঠান বা তার সহকর্মীদের সম্পর্কে কোন ধরনের নেতিবাচক কথা বলা যাবে না। অতিরিক্ত চাপের কাজগুলোর ক্ষেত্রে বা করপোরেট পরিবেশের নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে উপসংহারে পৌঁছা যাবে না।
অঙ্গভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাসী ও মার্জিত ভাব বজায় রাখা
এই কার্যকলাপের ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়ানো, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা, উষ্ণ করমর্দন, সোজা হয়ে বসা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। দ্রুত ঘাড় বা হাত নাড়ানো অস্থিরতার পরিচয় দেয়। তাই বাচনভঙ্গির জন্য যতটুকু মানানসই ঠিক ততটুকুই নড়াচড়া করা উচিত।
অনেক সময় মুখে আত্মবিশ্বাসী কথা বললেও শরীরের ভাষায় তা প্রকাশ পায় না। এদিকেও সতর্ক খেয়াল রাখা উচিত, নতুবা ইন্টারভিউ কক্ষে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। চুলে হাত দেয়া, বসে থাকার সময় চেয়ার বা পা নাড়ানো ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ নেতিবাচক ধারণার সঞ্চার করে। মুলত শরীরের কোন ভঙ্গিমায় যেন উদাসীন্য প্রকাশ না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: কর্ম জীবনে উন্নতির জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই কিভাবে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন
অতিরিক্ত কথা না বলা
যা প্রশ্ন করা হয়েছে উত্তরে নিজের দখল বোঝানোর জন্য বিশদ বিবরণ দেয়া ভালো লক্ষণ নয়। এতে অনেক জ্ঞানীর পরিচয় প্রকাশ হয় না, বরঞ্চ নিয়োগকর্তারা বিরক্ত হয়ে পড়েন। তাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলা একটি মারাত্মক ভুল। তাছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কথাগুলো প্রসঙ্গের বাইরে চলে যায়।
ফলশ্রুতিতে, এখানে চাকরিপ্রার্থীর কথা বলার দক্ষতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর যারা ভাবছেন কথা বলা মানেই পারদর্শিতা দেখানো তারা ভুলের স্বর্গে আছেন। যদি কোনো কিছুর ব্যাপারে সঠিক ধারণা না থাকে তা গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করাও একটি দারুণ স্কিল। তাই কথা বলায় পরিমিতি বোধ বজায় রাখা আবশ্যক।
বুদ্ধিদ্বীপ্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা
চাকরির ইন্টারভিউতে সফল হওয়ার জন্য এটি একটি সেরা কৌশল। ভাইভার শেষে অনেকেই আপনার কোন প্রশ্ন আছে কিনা জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়ে না বলে দেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়, বরং এতে নিয়োগকর্তাদের মনে হয় প্রতিষ্ঠান বা এই চাকরির ব্যাপারে হয়ত প্রার্থীর তেমন আগ্রহ নেই। তাই এই অংশে নিজের কৌতূহল প্রকাশ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান এবং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কতটুকু গবেষণা করা হয়েছে সেটাও প্রদর্শিত হয় এ অংশে। এ সময় প্রার্থীর একটি বুদ্ধিদ্বীপ্ত প্রশ্ন তাকে চাকরিটি পাইয়ে দিতে পারে।
আরও পড়ুন: যে ১০টি সফটওয়্যার জানা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে
ভাইভা বোর্ডে থাকা মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা অধিকাংশ সময় শুরুতেই প্রতিষ্ঠান ও চাকরির ব্যাপারে ধারণা দেন। সেই কথাগুলো কতটুকু মনযোগ দিয়ে শোনা হয়েছে তাও বোঝা যায় প্রার্থীর প্রশ্ন শুনে। এই কাজটি করার সেরা উপায় হলো ইন্টারভিউ কল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রস্তুতির সঙ্গে কয়েকটি প্রশ্নেরও তালিকা তৈরি করে রাখা প্রয়োজন।
ইন্টারভিউয়ের ফলো-আপ
সাক্ষাৎকারের পর ধন্যবাদ জানিয়ে ইমেল পাঠানো করপোরেট সংস্কৃতির একটি অংশ। এই কাজের ফলে নিয়োগকর্তা চাকরিপ্রার্থীর সেই সংস্কৃতি জ্ঞান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। ভাইভা শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজটি করার চেষ্টা করতে হবে। ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নির্দিষ্ট সেবা বা কাজের ব্যাপারে নিজের আগ্রহের ব্যাপারে জোর দেয়া যেতে পারে। একটি সুন্দর ফলো-আপ ইমেইলের মাধ্যমে সেই প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউয়ের দ্বিতীয় সুযোগও চলে আসতে পারে।
পরিশেষে
সবশেষে যা বলা হচ্ছে,তাহলো- চাকরির ইন্টারভিউতে সফল হওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ কৌশল অনুসরণে যে কেউ তার ইন্টারভিউ পূর্ববর্তী জটিলতাকে পাশ কাটাতে পারে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউয়ের সময় স্বভাবতই বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা আসতে পারে। কিন্তু প্রস্তুতিসুলভ কার্যকলাপগুলো বার বার করার মাধ্যমে দক্ষ হয়ে ওঠা যায়। ফলশ্রুতিতে নিজের বলা কথাগুলো আরও মসৃণ এবং আরও স্পষ্ট শোনাবে। এর জন্য ইন্টারভিউয়ের মহড়ার আয়োজন করা যায়, যেখানে কাছের কোন বন্ধুকে নিয়োগকর্তা বানানো যেতে পারে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা এক্ষেত্রে বেশ পুরনো একটি উপায়। এই কার্যকলাপগুলোর অডিও এমনকি ভিডিও রেকর্ড রাখলে পুরো সাক্ষাৎকারের পর্যবেক্ষণে অনেক ভুল-ত্রুটি বেরিয়ে আসে।
আরও পড়ুন: কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য কিভাবে নিজেকে গ্রুমিং করবেন?