খোকসা উপজেলা সদরের পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের চুনিয়াপাড়ার বাসিন্দা দরিদ্র কৃষক মাহফুজুর রহমান। খরিদীয় ৪৮ শতাংশ জমির সাড়ে ২১ শতাংশে তার নিজের বাড়ি। এখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে বাস করছেন। প্রতিবেশিরা দেয়াল তোলায় ও বাড়ি নির্মাণ করায় প্রায় এক বছর ধরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে কৃষক পরিবারটি। নিজের বাড়ির ভেতরে বাঁশের মই বেয়ে অন্যের দেয়াল টপকে এই পরিবারের লোকেরা আসা-যাওয়া করে।
তার বসত ঘরের পূর্ব দিকের ২৫ ফুট দূর দিয়ে সরকারি পাকা রাস্তা। বৃত্তবান সাইদুর রহমানের জমির আইল দিয়ে রাস্তায় উঠতো পরিবারটি। এ জমির মালিক রাস্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কৃষকের বসত বাড়িসহ জমির উপর নজর পড়ে তার। সস্তায় জমি কেনার কৌশল হিসেবে প্রথমে কৃষকের রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি রাখার গ্যারেজ ঘর তৈরি করা হয়।
বাড়িটির পূর্বদিকে বর্তমান মালিক সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক প্রসাদ বিশ্বাস তার জমিতে দেয়াল তুলেছে। অপর অংশে সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জীবন বিশ্বাস আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করেছে। দক্ষিণে সোনাতন নামে আরেক প্রতিবেশি দেয়াল তুলেছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে কৃষক মাহমফুজের পরিবারটি।
বাড়ি থেকে বের হতে রাস্তা পাবার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভার মেয়র, থানা পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গত এক বছরে কমপক্ষে ১২ বার সালিশ নিয়ে গেছে এই কৃষক। সবাই সালিশ করেছেন। প্রতিবারই রাস্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে প্রতিবেশিরা। কিন্তু শেষ অবদি আর রাস্তা পায়নি কৃষক।
সোনাতন নামের যে প্রতিবেশির জমির উপর দিয়ে গত এক বছর ধরে রাস্তায় উঠছে কৃষক পরিবারটি, সেই জমিতে ঘর তোলা হলে দেয়াল টপকে রাস্তায় ওঠার পথও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে মৌটুসিরা।
গত শনিবার কাকডাকা ভোরে স্কুলছাত্রী মৌটুসির দেয়াল টপকে রাস্তায় ওঠার দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। কথা বলা হয় শিশু মৌটুসির সাথে। সে জানায় তাদের দুর্দশার কথা। সে যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত সেই সময় থেকে শীত-বর্ষা বারোমাস নিজের বাড়ির ভিতর থেকে প্রথমে মই বেয়ে দেয়াল টপকে অন্যের জমির উপর দিয়ে রাস্তায় ওঠে। দেয়াল টপকে স্কুলে যাওয়ার সময় তিন/চার বার পা ফস্কে পড়ে গিয়েছে। হাত-পা কেটেছে কয়েক বার। কিন্তু উপায় নেই, স্কুলতো আর বন্ধ করা যাবে না।
মৌটুসির বাবা কৃষক মাফুজুর রহমান জানান, বৃত্তবান সাইদুর রহমান জমি কেনার সময় তাকে বাড়ি থেকে বেরোবার রাস্তা দেয়। কিন্তু কয়েক মাস পরে কৃষকের বাড়িসহ জমি কেনার প্রস্তাব দেয় বৃত্তবান এই প্রভাবশালী। এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাস্তা বন্ধ করে সেখানে গাড়ি রাখার গ্যারেজ ঘর তোলা হয়। এ সময় থেকে কৃষক রাস্তা পাবার জন্য চেষ্টা শুরু করে।
কিন্তু ওই প্রভাবশালী তাকে রাস্তা না দিয়ে অন্যত্র জমি বিক্রি করে দেয়। নতুন মালিকদের সাথে আপোষরফা করে রাস্তা পাবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু একটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ওয়াহিদুল ইসলাম খড়কাঠি নাড়ায় রাস্তা আর হয়নি বলে অভিযোগ করেন ওই কৃষক।
অবশেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভার মেয়র, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে কমপক্ষে ১২ বার সালিশ ডেকেছেন। বৃত্তবানদের বিরুদ্ধে সালিশ করে লাভ হয়নি। প্রতিবারই সালিশ হয়েছে। কিন্তু রাস্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর রাস্তা পায়নি মৌটুসিরা।
সোনালী ব্যাংক কুমারখালী শাখার ব্যবস্থাপক প্রসাদ বিশ্বাস মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে সাফ জানিয়ে দেন, কৃষককে রাস্তা দেয়া হবে না। প্রয়োজনে তিনি আরও প্রভাবশালী লোকের কাছে জমি বিক্রি করে দেবেন, তবুও রাস্তা দেবেন না।
আরেক প্রতিবেশি সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জীবন বিশ্বাস বলেন, সর্বশেষ জমি বিক্রির সময় তাকে (মাফুজুর রহমানকে) রাস্তার জমি কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই কৃষক নিজে তাদের অপমান করেছে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিকবার থানায় অভিযোগ করেছেন। পাকা পায়খানা ভেঙ্গে ঘরের পেছন দিয়ে রাস্তা দিলে তিনি আর বাড়িতে বসবাস করতে পারবেন না বলে জানান জীবন বিশ্বাস।
সাবেক অধ্যক্ষ ওয়াহিদুল ইসলাম উল্টো অভিযোগ করেন কৃষক মাফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে। সাইদুর রহমানের জমি বেচা-বিক্রি তার হাতে রয়েছে বলে জানান। সে সময়ে রাস্তার এক শতাংশ জমি কেনার জন্য কৃষককে প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু কৃষক রাজি না হওয়ায় তার রাস্তা বন্ধ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জমি বিক্রি করেছে তার ভাইরা। এখানে তার কোন শর্ত নেই। তবে তিনিও কৃষককে রাস্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে নিজেই রাস্তা নেয়নি।
খোকসা পৌরসভার মেয়র প্রভাষক তারিকুল ইসলাম বলেন, কৃষক মাহফুজুর শুধু অভিযোগ করে, নিষ্পত্তি করতে চায় না। সে চাইলে অনেক আগেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যেতে।
তিনি বলেন, আমি ঢাকায় আছি। এবারে ফিরে আবার গুরুত্ব দিয়ে রাস্তার সমস্যা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেবেন।