বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মাকসুদা ইকবাল নিপার প্রাণবন্তভাবে তৈরি করা বিমূর্ত চিত্রকর্মগুলোর ক্যালিডোস্কোপিক জগৎ ব্যক্ত করে কসমস বুকস দশম ঢাকা সাহিত্য উৎসব বা ঢাকা লিট ফেস্টে (ডিএলএফ) 'এপিসোডস অব হার গেজ'-এর মোড়ক উন্মোচন করেছে।
কসমস বুকস থেকে প্রকাশিত নিপার জাঁকজমকপূর্ণ শিল্পকর্মের এটি প্রথম প্রকাশনা। শুক্রবার রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে ডিএলএফ-এর কসমস বুকস স্টলে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন ইউএনবি’র ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন স্ট্র্যাটেজিস্ট নাবিলা রহমান।
কসমস বুকসকে তার প্রথম চিত্রকর্মের সমষ্টিগত প্রকাশনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাকসুদা ইকবাল নিপা বলেন যে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তিন বছরের বিরতিতে এই বছরের ডিএলএফে ফিরে আসতে পেরে তিনি সম্মানিত হয়েছেন।
নিপা ইউএনবিকে বলেন, ‘বইটির ধারণাটি আমার সমসাময়িক শিল্পকর্মগুলো থেকে প্রতিফলিত হয়েছে, যা আমি জাপানে আমার স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সময় শুরু করেছিলাম। এই বইটিতে আমার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীর ২০০টির মতো শিল্পকর্ম রয়েছে এবং এটি শিল্পী ও শিল্প লেখক জাভেদ জলিলের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও এই প্রকাশনাটি এর আগে জাতীয় জাদুঘরে আমার একক প্রদর্শনীর সময় ও পরে ঢাকা আর্ট সামিট-এ প্রকাশ করা হয়েছিল। এই প্রকাশনার মাধ্যমে এই প্রথম আমার চিত্রকর্মের সমষ্টি ডিএলএফে প্রদর্শিত হচ্ছে।’
বইটি সম্পাদনা করেছেন ক্যাথরিন গ্রেস গার্ডেনার ও মুবিন শাদমান খান এবং লেআউট ও ডিজাইন তৈরি করেছেন এআরকে রিপন। বইটির জন্য তার শিল্পকর্মের ছবি তুলেছেন নিপার স্বামী; স্বনামধন্য শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল, এআরকে রিপন, হোসেন শহীদ ইকো, মিজানুর রহমান খোকা, রেজাউল হক, রাসেল চৌধুরী ও সৌরভ চৌধুরী।
আরও পড়ুন: কসমস ফাউন্ডেশনের প্রদর্শনীতে আলেকজান্দ্রু পোটেকা ও নিপার শিল্পকর্ম
বইটিতে প্রয়াত অস্ট্রেলিয়ার চিত্রগ্রাহক ডক্টর জিম ফ্রেজিয়ারের একটি মুখবন্ধও রয়েছে, যিনি ক্যামেরার পেছনে একজন পথপ্রদর্শক এবং স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরোর সঙ্গে কাজ করেছেন। একাধিক পুরস্কার বিজয়ী এই প্রকৃতিবিদ ২০১৫-২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশে ছিলেন তখন নিপার কাজের প্রেমে পড়ে যান।
বিমূর্ত চিত্রকলার উজ্জ্বল জ্ঞানের সঙ্গে একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী ও প্রাণবন্ত বিমূর্ততার জন্য পরিচিত মাকসুদা ইকবাল নিপা ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে তার বিএফএ (ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং) ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিনি জাপানের আইচি ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনে পোস্ট-গ্রাজুয়েট রিসার্চ কোর্সে (অয়েল পেইন্টিং) ভর্তি হন। নিপা ২০০৪ সালে আইচি ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন থেকে ফাইন আর্টস (পেইন্টিং) বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জাপানে থাকাকালীন নিপার শৈল্পিক শৈলীটি প্রতিনিধিত্বমূলক থেকে তার নিজস্ব ধাঁচের বিমূর্ততায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়।
ফরাসিতে একটি বচন রয়েছে যে ‘আর্ট ফর আর্ট’স সেক’ বা শিল্পের জন্য শিল্প – এর একজন প্রবক্তা হিসেবে নিপার যাত্রা সর্বদাই স্বাধীন এবং কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষামূলক, নৈতিক, উপযোগী বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ না করার জন্য অবিচল। নিপার শিল্পকর্মগুলো বিমূর্ত, আবেগপ্রবণ, একজন নারী ও একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রতিদিন যে কষ্ট সহ্য করেন তার ভিজুয়াল ডায়েরি।
তিনি সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা ও যে নিপীড়নের মুখোমুখি হন তা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই শিল্পকর্মগুলো তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হন। নিপীড়ন থেকে মুক্তি বলতে কী বোঝায় তা আবিষ্কার করার সময় তিনি বড় ক্যানভাসে তৈলচিত্র তৈরি করেন ও পরীক্ষা করেন।
একজন নারী ও শিল্পী হিসেবে নিপার যাত্রা হল জন্মের স্থান, দীর্ঘকাল ধরে চিন্তাভাবনা ও নীরব কল্পনার অস্পষ্ট উড্ডয়ন নিয়ে পরিশ্রম করা। তার সচিত্র পরামিতি হল দেখা, অদেখার ক্ষেত্র ও চোখ দিয়ে নেয়া তথ্যের মুহূর্তগুলোর গ্রহণ। কিন্তু তার যোগসূত্র হল পরিবেশের সংবেদনশীল অচেতন মিলনের সঙ্গে যেখানে সে পালিয়ে বেড়ায়, সেখানে সুখের সন্ধান করা।
কৌতূহল ও সন্দেহের আবরণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শব্দগুলো তার কল্পনাপ্রসূত চিন্তার ক্ষেত্র।
আরও পড়ুন: ‘ধারণার চেয়েও বেশি’: মধ্যযুগে বাংলায় হাবশি শাসন এবং আফ্রিকা-ভারত সংযোগ সম্পর্কে ড. কেনেথ রবিন্স
একজন শিল্পী হিসেবে নিপার অভ্যন্তরীণ মেজাজ ও লুকানো আত্মার স্মৃতিচারণ হছে- একটি অন্বেষণ, যা তিনি অস্থির তাগিদ ও মেজাজের নীরব আভাস দিয়ে ধ্যান করেন। যা ক্যানভাসের বিদ্যমান স্ব-দৃষ্টিতে থাকা ডায়েরির সঙ্গে ধীরে ধীরে বেঁচে থাকে।
নিপা তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর, ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তর, জাপানের টয়োটা মিউনিসিপ্যাল আর্ট মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস আর্ট মিউজিয়াম, কোরিয়ার সিউলের ইয়ংওন কর্পোরেশনসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য একক ও দলীয় শো করেছেন। তিনি তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন। নিপা জাপান, চীন ও বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও অনুদান পেয়েছেন।