প্রচন্ড গরম ও বৃষ্টি মৌসুমের কারণে করোনা মহামারির সাথে পাল্লা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু জ্বর। এ সপ্তাহের প্রথম দিকেই ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ছয় জন ডেঙ্গু রোগী। সরকারি প্রতিবেদন মতে, নতুন বছরে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৯৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এমন চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় আপনার নিজের ও পরিবারের সুস্থতার জন্য সতর্ক থাকা জরুরী।
কীভাবে বুঝবেন ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে
প্রথম দিন থেকেই প্রচণ্ড জ্বরের সাথে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, চোখের পেছনে ব্যথা হয়, শরীর ব্যথা করে, এবং চামড়া লাল হয়ে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে বমিও হয়।
ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের অনুচক্রিকার মাত্রা বিপজ্জনক হারে কমে যায়। এতে দাঁত, ত্বকের নিচে, নাক প্রভৃতি স্থানে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। জ্বর সাধারণত টানা ৫–৬ দিন থাকে। আবার কখনো অপেক্ষাকৃত কম সময় ধরে জ্বরের পরই হঠাৎ জটিল আকার ধারণ করে।
আরও পড়ুন: সাইক্লিং, দৌড় কিংবা সাঁতার: ওজন কমাতে কোনটি বেশি কার্যকরী?
কখনো আবার চামড়ায় দানা বা গায়ে ব্যথার পরিবর্তে কাশি, বমি হওয়া, পাতলা পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বের হয়। বিভিন্ন অঙ্গ নষ্ট যেমন কিডনি, যকৃত, মায়োকার্ডাইটিস হয়। বুক ও পেটে পানি জমার মতো জটিলতা দেখা দেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ, বুকে ও পেটে পানি আসা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এ অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের স্বাভাবিক জটিলতার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ এডিস মশার কারণে হয়, তাই এই সংক্রমণ রোধে এডিস মশার বংশ নির্বংশ করা দরকার। জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। তাই ঘরে সাজানো ফুলদানি, ছাদ-বাগানের টবে, অব্যবহৃত কৌটা, রান্নাঘরের হাউজ, বাথরুম, অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকিসহ যেকোনো জায়গায় জমে থাকা পানি তিন থেকে পাঁচ দিন পরপর ফেলে দিন। এতে করে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস হবে। পাত্রের গায়ে মশার ডিম লেগে থাকতে পারে বিধায় পাত্রটি ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করুন।
এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ালেও রাতের উজ্জ্বল আলোতেও এরা কামড়াতে পারে। তাই মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি টাঙানোর পাশাপাশি সম্ভব হলে ঘরের দরজা ও জানালায় নেট লাগিয়ে নিন।
আরও পড়ুন: কিভাবে বাড়িতেই ভেজাল দুধ শনাক্ত করবেন
দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর কর্পূর জ্বালিয়ে রাখুন। ২০ মিনিট পর দেখবেন মশা একদম নেই। প্রয়োজনে মশা নিরোধক স্প্রে, লোশন, ক্রিম, কয়েল ম্যাট ব্যবহার করুন। হাফ-হাতা বা হাফ-প্যান্টের বদলে ফুল-হাতা বা ফুল-প্যান্ট পরুন। এতে করে শরীর মশার কামড়ের জন্য কম উন্মুক্ত থাকবে।
তুলসীগাছ মশা তাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া গাপ্পি মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে বলে বিভিন্ন দেশে মশা নিধনে গাপ্পি ব্যবহার করা হয়।
শুধু ভেতরেই নয়, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়, রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো ফুলের টব, গাছপালা ইত্যাদি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। বৃষ্টির ফলে এগুলোতে যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখুন। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন বাড়ির আশেপাশে মশা নিধনের ওষুধ ছিটান।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরে বিচলিত না হয়ে পর্যাপ্ত পানি পান করুন, শরীর মুছে নিন, বিশ্রাম নিন এবং মাথায় পানি দিন। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয় বিধায় প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরলজাতীয় খাবার, যেমন- ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করুন। জ্বর প্রথম দিন থেকেই জটিল আকার ধারণ করলে সাথে সাথে ডাক্তারের সরণাপন্ন হন।
আরও পড়ুন: ইকিগাই: জাপানিদের সুস্থ জীবনের রহস্য!
কিছু ব্যাপারে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে।
* ডেঙ্গু জ্বর হলেই রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
* ডেঙ্গু হওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে।
আসলে রক্তে প্লাটিলেট কমে গেলে তখন জরুরি ভিত্তিতে প্লাটিলেট দিতে হয়। আর বারবার বমির কারণে যদি কোনো রোগীর পানি পানের অবস্থা না থাকে, তখন শিরাপথে স্যালাইন দেয়া লাগে।
শেষাংশ
ডেঙ্গু জ্বর সহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণে প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা। তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করুন। তাছাড়া বৃহৎ পরিসরে প্রতিরোধ গড়ে তুললে যে কোনো জরুরী অবস্থা থেকে আপনি নিজেকে ও নিজের পরিবারকে মুক্ত রাখতে পারবেন।