বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই নৈসর্গিক নিরবতা পাহাড়ের চারপাশে। কেবল মৌসুমি হাওয়ার মতো তীব্র বাতাস ছুটে আসছিল নীচের পাহাড়গুলো ছুঁয়ে। নক্ষত্র আর মিল্কিওয়েতে ভরা ছিল সাজেকের রাতের আকাশ। থোকায় থোকায় আকাশে জ্বলছিল তারার দল। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চেনা রাতকেও যেন অচেনা লাগছিল বার বার।
আমাদের দেশে এত সৌন্দর্য্য রয়েছে যা এতদিন আমার খোলা দৃষ্টির বাইরে ছিল যতবার ভেবেছি ততবার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি এত সুন্দর প্রকৃতি দুচোখ ভরে দেখবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে।
ভ্রমণ পিপাসু মনকে সান্ত্বনা দিতে কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম কোথায় গেলে এত অপূর্ণতার মাঝে মনকে কিছুটা পূর্ণতা দেওয়া যায়। আমার কাজিন (শুভ) হঠাৎ একদিন জানালো সাজেক যাওয়া যেতে পারে। সিদ্ধান্ত নিতে আর কাল বিলম্ব করিনি। ৪৮ জনের একটা গ্রুপের সাথে আমাদের এডমিন দীপ্ত দাদার নেতৃত্বে আমাদের ৬ জনের একটা গ্রুপ রওনা করলাম ঢাকা কল্যাণপুর থেকে রাত সাড়ে ৯টার গাড়িতে। একই সময় চট্টগ্রাম থেকে রওনা করলো আমাদের আরেকজন। বাকিরা সবাই রিজার্ভ গাড়িতে রওনা করলো ফেনী থেকে। আমাদের গ্রুপের নাম ছিল গন্তব্যহীন ট্রাভেল স্টেশন। এর আগে অন্য আরেকটা গ্রুপের সাথে ভ্রমণ করেছি। এটা দ্বিতীয় গ্রুপ ভ্রমণ ছিল। তাই এত সংখ্যক মানুষের সাথে কিভাবে মানিয়ে নেবো তেমন কিছু নিয়ে ভাবিনি।
বাসের সিট পিছনে থাকায় ইঞ্জিন কাভারেই কাটিয়েছি অধিকাংশ সময়। খাগড়াছড়ি শহর পার হয়ে দিঘীনালা পৌঁছতেই ভোরের আলো জানান দিচ্ছিল আসে-পাশের পাহাড়ের বিশালতা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় কখনও ধীরে কখনো তীব্র গতিতে ছুটে ঠিক সকাল ৭টায় দিঘীনালা পৌঁছে দিল আমাদের গাড়ি। এখান থেকেই মূলত চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে হয়।
খিচুড়ি আর মহিষের মাংস দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে আমাদের টিম মেম্বাররা যখন চাঁদের গাড়ির জন্যে অপেক্ষারত তখন পাশের স্থানীয় বাজার থেকে কিছুটা হেঁটে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়ালাম। রাস্তার ধারে ছোট একটি বাজারে নাম না জানা কিছু পাহাড়ি সবজি ছাড়া খুব বেশি কিছু ছিলনা আমার কেনার মত।
এদিকে, চাঁদের গাড়ির সময় কাছে চলে আসায় আমি আর কাল বিলম্ব না করে গাড়ির স্ট্যান্ডে ফিরে আসি। চাঁদের গাড়িতে রওনা হতেই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো যেনো এক শীতল খুশির অনুভূতি। নিয়ম অমান্য করেই ৩/৪ জন চলে গেলাম চাঁদের গাড়ির ছাদে। যত দামী গাড়ি হোক ইঞ্জিন পাওয়ার থাকে সাধারণত পিছনের দুই চাকায় কিন্তু চার চাকায়ই ইঞ্জিন পাওয়ার বিশিষ্ট পাহাড়ি রাস্তায় চলার একমাত্র বাহনটি যখন পাহাড়ের পর পাহাড় পার হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেনো উড়ে উড়ে এগিয়ে চলেছি অসীমের দ্বারে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার দুধারেই গিরিখাত। কিছুক্ষনের জন্যে নিজেকে পাখিই ভেবে নিয়েছিলাম হয়তো। তার উপর রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসী বাচ্চারা যখন হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছিল তাদের পাহাড়ি জনপদে নিজেকে তখন তাদের মেহমান মনে হচ্ছিল। এ যেনো এক নতুন অনুভূতি।
ঠিক বেলা ১২টায় পৌঁছলাম ১৮০০ ফিট উচ্চতার পাহাড়ের চূড়া সাজেকে। চূড়ায় উঠতেই চোখে পড়লো রাস্তার দুধারে গড়ে ওঠা কিছু হোটেল। আমাদের হোটেলটি আগে থেকে নির্ধারিত থাকায় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। হোটেলে প্রবেশপথ বারান্দা হয়ে। আমাদের কামরাটি পেছন দিকে হওয়ায় ঝুলন্ত বারান্দা থেকেই দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। ফ্রেশ হতে যে কামরায় ঢুকবো সেই ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিয়েই কিছুক্ষন দাড়িয়ে উপত্যকার সৌন্দর্য্য দুচোখে ধারণ করে নিলাম।
নির্ধারিত কামরায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় চোখ কিছুটা কপালেই উঠে গেলো মেনু দেখে। পাহাড়ি বাঁশের সবজি,ব্যাম্বু চিকেন,পাহাড়ি আলু ভর্তা আর ডালের সঙ্গে সাদা ভাত। সাধারণত যতখানি খাই ওইদিন দুপুরে বোধয় তার চেয়ে কিছুটা বেশিই খেলাম খাবারের স্বাদের আনন্দে। খাওয়া শেষে চা খেতে গিয়ে দেখি এখানেও বাঁশের সুনিপুণ কারিগরী। বাঁশের তৈরী কাপেই খেতে হবে চা। বেশ আগ্রহ নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে এর স্বাদের কাছে নিজেকে সপে দিলাম।
পুরো দুপুর বিশ্রামে থেকে সন্ধ্যার কিছু আগে হেঁটে হেঁটে গেলাম সেনাবাহিনীর তৈরি হেলিপ্যাড- এ। যেখানে বসেছে পাহাড়ি কিছু খাবারের অস্থায়ী দোকান। সাজেকে ঘুরতে আসা প্রায় অধিকাংশ পর্যটকই তখন হেলিপ্যাডে নিজেদের মত করে সময় কাটাতে ব্যাস্ত। আমিও তাদের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। দীপ্ত দাদার গানের দলের সাথে গানের সুরে সুর মেলানোর চেষ্টা করলাম। পুরো সন্ধ্যাটা সেখানেই কাটালাম।
রাতের খাবারে ছিল ব্যাম্বু চিকেন বিরিয়ানি। যা ওখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে অন্যতম। এখানেও সেই বাঁশের সুনিপুণ ব্যবহার। আগুনের অনিয়ন্ত্রিত তাপে বাঁশের ভেতরেই সিদ্ধ হয় মুরগির মাংসের বিরিয়ানী। যা এখনও মুখে লেগে আছে। খাওয়া শেষে সবাই হোটেলে ফিরে গেলেও আমরা তিন বন্ধু আর হোটেলে ফিরে যাইনি। রাতের সৌন্দর্য দেখতে এগিয়ে গেলাম আবার হেলিপ্যাডের কাছাকাছি একটি জায়গায়। যেখানে বেঞ্চের ধারেই খাড়া পাহাড়। ওই বেঞ্চিতে বসে রিন্টুর হাতে বাজানো তালে আফতাব যখন গাইলো..... এই তারা ভরা রাতে আমি পারিনি বোঝাতে....আমি তখন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা আকাশের তারাদের কাছে নিজের ভালোলাগার চরমে ঠাই দিলাম। পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত ছিল পুরো উপত্যকা। পরদিন ভোর ৫টায় উঠতে হবে তাই আর বেশি রাত পর্যন্ত রাতের মুগ্ধতা নেওয়ার সুযোগ হয় ছিল না।
পরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো জানালা দিয়ে চোখ গেলো বাইরে। রাতের অন্ধকার তখন ঘুচে যেতে শুরু করেছে। যেভাবে ড্রয়িং করার সময় পেনসিলে এঁকে এরপর রং করা শুরু হয় তেমনি মনে হচ্ছে এই ভোরবেলা চারপাশটা কেউ রং করা শুরু করল। মিষ্টি বাতাসের সঙ্গে খালি চোখে মেঘের ভেলা দেখে আর বিছানায় থাকতে পারিনি, উঠে যাই বারান্দায়। পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে লাল আভায়। পাহাড়, মেঘের ওপর এমন লাল আভা চমৎকার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড়।
ফ্রেশ হয়ে রওনা করলাম কংলাক পাড়ার দিকে। আবারও সেই আঁকাবাঁকা জরাজীর্ণ পাহাড়ি পথে ছুটলো আমাদের চাঁদের গাড়ি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তুলোর মতো সাদা মেঘ। ছোট ফুটপাতের পরিচ্ছন্ন সাজেকের প্রথমে রুইলুইপাড়া। আমরা রাতে যেখানে ছিলাম সেটাই রুলুইপাড়া। আর শেষ মাথায় কংলাক পাহাড়ের চুড়ায় কংলাকপাড়া। দুই পাড়ার মধ্যে ৩০-৪০ মিনিট হাটার দুরত্বের কিছুটা পাকা আর কিছুটা মেঠোপথ।
এখানে লুসাই, পাংকুয়া ও ত্রিপুরাদের বসবাস। প্রকৃতির মত সুন্দর পাহাড়ের সহজ সরল আদিবাসী মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে হয়তো অনেক কিছু শেখার আছে। কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেকের পূর্বে ভারতের মিজোরাম আর উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য। পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং দক্ষিনে রাঙ্গামাটির লংগদু।
কংলাকের চুড়ায় না উঠলে সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ বৃথা। এখান থেকে সবুজ পাহাড় ও মেঘের সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছিল সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মায়ায় নিজেকে বেধে ফেলছি।
কংলাক পাহাড় থেকে নামতে নামতে ফেরার ঘণ্টা বেজে গেলো। ফেরার পথে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তাটা শেষ করেই রওনা করলাম ঢালু রাস্তায় রোলার কোস্টারে চড়ার অনুভূতি নিয়ে সাজেককে পেছনে ফেলে খাগড়াছড়ি শহরের পথে।
মেঘের রাজ্য সাজেক মুগ্ধ করেছে যতোটা তার চেয়ে বেশি ব্যাথিত করেছে সেখানকার আদিবাসীদের জীবন ব্যবস্থার করুন চিত্র। আমার দৃষ্টি সবসময় খুঁজে ফিরেছে জীবন বৈচিত্র্যের পার্থক্য। ফেরার পথে পাহাড়ি আদিবাসীদের শুধুমাত্র বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বিহীন ঘরবাড়ি আর জরাজীর্ণ শিশুদের পাহাড়ি রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থেকে হাত নাড়ানোর দৃশ্য আমার মনে দাগ কেটে গেছে। বার বার মনে হয়েছে এই অসহায় চোখের চাহুনি আর হাতের ইশারা হয়তো কিছু বলতে চায়। হয়তো জানতে চায় কেন আমরা এত অবহেলিত। সময়ের সাথে সাথে আমিও হয়তো ব্যাস্ত হবো আমার বিভিন্ন কাজে। তাদের ওই নিরব প্রশ্নের উত্তর দিতে কখনো যাওয়া আর হবে কিনা জানিনা। তবে সারাজীবনের জন্যে হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে যাওয়া এই স্মৃতিগুলোই হয়তো আমার বৃদ্ধ বয়সের খোরাকি যোগাবে। এই আদিবাসী মুখগুলোই হয়তো বৃদ্ধ বয়সে সকলের অবহেলায়ও নিজেকে চুপ থাকা শেখাবে।
সম্প্রতি সাজেক থেকে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এম এইচ অপু