উপমহাদেশের একমাত্র লাল বর্ণের জাগ্রত দুর্গা দেবীর পূজা উদযাপিত হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে। লাল রঙের দুর্গা দেবীকে দেখতে দেশ-বিদেশের পূণ্যার্থীরা ছুটে আসেন এখানে।
বুধবার ষষ্ঠীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহা উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রতিবছরের মতো দেবীর পূজা দেখতে দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও ভক্তরা এসেছেন এখানে।
অষ্টমী ও নবমীর দিন এত ভক্তের আগমন ঘটে যে, সারিবদ্ধভাবে গাড়ি পার্কিং ও মেলা বসায় মানুষের চাপের কারণে ২ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে দেবী দর্শন করতে যেতে হয়।
প্রায় ৩০০ বছর একইভাবে পূজার আয়োজন হয়ে আসছে পাঁচগাঁওয়ে। ৯ অক্টোবর এ পূজা শুরু হয়ে ১২ অক্টোবর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে পূজামণ্ডপে ইসলামী গানের ঘটনায় আটক ২: পুলিশ
আয়োজকরা জানায়, মৌলভীবাজার থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ও রাজনগর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁও গ্রামে স্বর্গীয় সর্বানন্দ দাস (বর্তমান সঞ্জয় দাসের) বাড়িতে পালিত হয়ে আসছে ব্যতিক্রম এই পূজা।
প্রতি বছর পূজার সময় মহিষ বলির পাশাপাশি শত-শত পাঁঠা, হাঁস-কবুতর বলি দেওয়া হয়। তাছাড়া দুর্গার জন্য নগদ টাকা, শাড়ি, গহনা সোনা রৌপ্য অলংকারসহ প্রচুর পরিমাণ দক্ষিণা নিয়ে আসেন পূজার্থীরা।
স্থানীয়রা জানায়, জনশ্রুতি আছে পাঁচগাঁও পূজা মণ্ডপের তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জয় দাসের পূর্বপুরুষ সাধক সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি আসামের কামরূপ-কামাক্ষ্যায় এক বাড়িতে গিয়ে কুমারী পূজা করেন। ছয় ঘণ্টা পূজার পর প্রণাম করার সময় সর্বানন্দ দাস দেখতে পান, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। সেসময় তিনি ওই কুমারীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা আমার পূজা সুপ্রসন্ন হয়েছে কি?’ উত্তরে কুমারী রূপে ভগবতী বলেন, ‘হ্যাঁ তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে, আমি তোর পূজায় সন্তুষ্ট হয়েছি। এই বর্ণে তোর গ্রামের বাড়ি পাঁচগাঁও পূজামণ্ডপে আবির্ভূত হয়েছিলাম।’ সর্বানন্দ দাস এর প্রমাণ চাইলে ওই কুমারী হাতের পাঁচ আঙুলে রক্তের ছাপ দেন আর মাথা থেকে স্বর্ণের টিকলি খুলে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাড়ির বেড়ায় পাঁচ আঙুলে ছাপ আছে আর এই টিকলি দিয়ে প্রতি বছর মহাষ্টমী তিথিতে স্নান দিয়ে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি।’
পরবর্তী বছর দুর্গাপূজার আগে সর্বানন্দ দাস বাড়ি ফিরে বেড়ায় হাতের পাচঁ আঙুলে ছাপ দেখতে পান। সেই লাল বর্ণের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে লাল বর্ণে রঞ্জিত করেন দেবীদুর্গাকে। এভাবেই প্রায় ৩০০ বছর ধরে সঞ্জয় দাসের বাড়ির মণ্ডপে লাল বর্ণের দুর্গার পূজা হচ্ছে।
এই পূজাকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন পরিষদের ভেতর ও মণ্ডপের আশেপাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পোশাক, বই, ফার্নিচার, খই, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টি, খেলনা ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন প্রায় ৬ শতাধিক বিক্রেতা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রাজনগর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক টিংকু পুরকায়স্থ বলেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছাড়াও সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের সার্বক্ষণিক সাহায্য সহযোগিতায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে পালন হবে এবারের শারদীয় দুর্গাপূজা।
রাজনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অসিত দেব বলেন, উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এবার অধিকতর আনন্দ উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন হবে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দেব বলেন, দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সব জাতি-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সহযোগিতা আন্তরিকতায় আমরা অভিভূত।
তিনি আরও বলেন, দুর্বৃত্ত কোনো জাতির নয়, সমাজের নয়, গোটা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের আনন্দমুখর পরিবেশে উদযাপিত হোক শারদীয় দুর্গাপূজা।
রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মোহাম্মদ মোবাশ্বির হোসেন বলেন, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা পূজা চলাকালে প্রত্যেক মণ্ডপে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র্যাব ও বিজিবিও টহল দিচ্ছে।
এছাড়াও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চালু রাখতে পল্লী বিদুৎ অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, দুর্গাপূজায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ মণ্ডপে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারিভাবে ৭৫টি পূজা মণ্ডপে ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বাগেরহাটে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে