এছাড়া পাইকগাছার সোলাদানা ইউনিয়নে নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙন ও পৌরসভা সদরে অতিরিক্ত জোয়ারে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা উপচে পড়া নদীর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
কয়রা উপজেলায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে মৎস্য ঘের, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সহস্র পরিবার।
জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ভরা পূর্ণিমায় নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ভেঙে গেছে-দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা, গোলখালী, উত্তর বেদকাশীর গাতীর ঘেরি, মহেশ্বরীপুরের তেঁতুলতলার চর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও মঠবাডী (পবনা) এলাকার বেড়িবাঁধ।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম শামসুর রহমান বলেন, নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আংটিহারা ও গোলখালী গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া জোড়শিং বাজার থেকে বীণাপাণি অভিমুখে রাস্তা উপচে জোয়ারের পানি ভেতরে প্রবেশ করছে।
মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু বলেন, কপোতাক্ষ ও শাককবাড়িয়া নদীর পানি বৃদ্ধি হওয়ায় দুপুরের দিকে দশ হালিয়া ও মঠবাড়ী (পাবনা) বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। এতে ভেসে গেছে মাছের ঘের, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার।
কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ইউনিয়নের ৭টি জায়গায় পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করার উপক্রম হয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক এলাকার স্থানীয় জনগণ কাজ করে পানি আটকাতে সক্ষম হয়। তিনি জরুরি ভিত্তিতে এসব এলাকায় কাজ করার দাবি জানান। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ৪০টি স্থানের পানি উপছে লোকালয়ে প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুজ্জামান বাপ্পি বলেন, ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ আটকানোর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ জন্য পাউবো’র পক্ষ থেকে বস্তা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হবে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে নোনাপানি আটকানো সম্ভব হবে।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহারাজপুর ইউনিয়নে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দ্রুত সময়ের মধ্য আটকানো হবে। যে সমস্ত এলাকায় ওভারফ্লো হয়ে জোয়ারের পানি ভিতরে প্রবেশ করেছে সেগুলো মেরামত করা হবে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপজেলার কামিনিবাসীয়ায় ভেঙে গেছে বাঁধ। জোয়ারের তোড়ে বাঁধ ছাপিয়ে চালনা পৌর সদরসহ বেশ কিছু এলাকায় পানি ঢুকে বসত ভিটে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিমজ্জিত হয়েছে। উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে। এলাকাবাসী এই বিপর্যয়ের জন্য পাউবো’র উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন।
স্থানীয় নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ার অপেক্ষা আনুমানিক তিন ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। চারিপাশে নদী বেষ্টিত উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও চালনা পৌর এলাকার ১০-১২টি স্থানে ওয়াপদা বাঁধ ছাপিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঢাকী নদীর পানির চাপে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনিবাসিয়া সোনার বাংলা কলেজ এলাকার বেড়িবাঁধ বুধবার দুপুরের জোয়ারে ভেঙে যায়। ফলে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নসহ ৩১নং পোল্ডার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উপজেলার কালাবগী, নলিয়ান, সুতারখালী, বটবুনিয়া বাজার, ঝালবুনিয়া, পানখালী জাবেরের খেয়াঘাট, পানখালী পুরাতন ফেরীঘাট, খোনা, লক্ষিখোলা পিচের মাথা, চালনা পৌরসভার গোড়কাটি এবং খলিষা এলাকার বাঁধ ছাপিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে যায়। এর মধ্যে গোড়কাটি, পুরাতন ফেরীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে আছে। কালাবগী ফকির কোনা, ঝুলনপাড়া, নলিয়ান বাজার, পানখালী জাবেরের খেয়াঘাট, চালনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডসহ বেশ কিছু এলাকায় ওয়াপদা বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারী প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিতে পুরোপুরি নিমজ্জিত।
দাকোপ উপজেলার কামিনিবাসিয়া এবং পানখালী এলাকায় প্রায় আটশ’ শ্রমিক কাজ করছে। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু জিও ব্যাগ দিয়ে দায় সেরেছেন বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘদিন ঝুঁকিতে থাকা এ সকল বাঁধ নির্মাণে এগিয়ে না আসায় এ অবস্থা। চলমান পরিস্থিতির জন্য কতৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন তারা।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও পূর্ণিমার জোয়ারে নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পৌরসদরের পৌরবাজার সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অধিকাংশ ওয়াপদার বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। তবে ঠিক কি পরিমাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাণ করা এখনও সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন আশ্রায়ন কেন্দ্রেগুলোতে প্রায় ২০০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে।
জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারে বুধবার সকালের দিকে পাইকগাছা পৌরসদরের বাজার সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। বাজারের কাঁচামালের পট্টি, সোনা পট্টি, কাপড়ের পট্টি, কাঁকড়া পট্টি, মাছ বাজারসহ পৌর বাজারের সকল রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে।বিভিন্ন দোকানে পানি উঠে যায়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ে দোকান মালিকসহ ক্রেতা সাধারণ। বিকেল তিনটার দিকে নদীতে ভাটা এলে আস্তে আস্তে পানি সরে যায়। উপজেলার কপিলমুনির আগড়ঘাটা বাজার সংলগ্ন পদ্মপুকুর এলাকায় বাঁধ, দেলুটির চকরিবকরি, গেয়ুবুনিয়া, মধুখালী, পারমধুখালী, রাড়–লীর মালোপাড়র বাঁধ ভেঙে এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের ওয়াপদার বাঁধ উপচে এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে।
গড়ইখালী ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ইউনিয়নের কুমখালীর (খুদখালী) ফকির বাড়ির সামনে ১০/১২ নং পোল্ডারের শান্তা ¯সুইচ গেটে সংলগ্ন ও গাংরখি নদীর গেটের দুইপাশে ভাঙনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কর্মসৃজন কর্মসূচির লোক দিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
দেলুটি’র ইউপি চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল জানিয়েছেন, ইউনিয়নের চকরিবকরি, গেয়ুবুনিয়া, মধুখালী, পারমধুখালীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া জিরবুনিয়ার চৌমূহনী, দেলুটির শিবসা নদীর পাশে, ২২নং পোল্ডারের দারুণ মল্লিক, কালীনগর, তেলেখালি, দুর্গাপুর ও বিগরদানার বাঁধ উপচে এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
লতা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান কাজল কান্তি বিশ্বাস জানিয়েছেন, ইউনিয়নের ধলাই এলাকার বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে এলাকায়। এছাড়া লতা গ্রামের বাঁধ ভেঙে গেছে। সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান গাজী জানান, সোলাদানা ইউনিয়নের ২৩নং পোল্ডারের পাটকেলপোতা, আমুরকাটা স্লুইচ গেট, বাসাখালী ও পতন, বেতবুনিয়া ও সোলাদানার আবাসন এলাকার বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
আরও পড়ুন: ফরিদপুরে এক মিনিটের ঘূর্ণিঝড়ে শতাধিক ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড
রাড়ুলী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ গোলদার জানান, ইউনিয়নের ৯নং পোল্ডারের মালোপাড়া ও ভড়ভুড়িয়ার গেট এলাকার ১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে দুপুরের কপোতাক্ষ নদের জোয়ারের পানি উপচে মালোপাড়া তলিয়ে যায়।
কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার জানিয়েছেন, মঙ্গলবারে রাতের জোয়ারে আগড়ঘাটা বাজার সংলগ্ন পদ্মপুকুর এলাকার বাঁধ ভেঙে ৪০/৫০টি বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। বুধবার সকালের দিকে জোয়ারের পানি কিছুটা কমলে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করেও পুনরায় নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে বাঁধ দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানিয়েছেন, উপজেলার কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ও ওয়াপদার বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। তবে এতে কি পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সঠিকভাবে এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ডুমুরিয়ায় প্রচন্ড আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে জোয়ারের পানি। চরাঞ্চল ও নদীর তীরের রক্ষাবাঁধগুলো রয়েছে হুমকির মুখে। পানির প্রভাবে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা হয়েছে নিমজ্জিত।
জানা গেছে, উপজেলার অভ্যন্তরীন নদীগুলোতে অস্বাভাবিক হারে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রভাবে হুমকিতে রয়েছে সাহস ইউনিয়নের লতাবুনিয়া বাশতলা, চটচটিয়া, শোভনা ইউনিয়নের বাগআঁচড়া বাদুরগাছা, কদমতলা, বারুইকাঠি, পাতিবুনিয়া, জিয়ালতলা, ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের আবাসন, জাবড়া, তেলিখালি, ধানিবুনিয়া বকুলতলা, শরাফপুর ইউনিয়নের চাঁদগড় জালিয়াখালী, আসাননগর, মাগুরখালীর শিবনগর, খোরেরাবাদ, আটলিয়ার বরাতিয়া, কুলবাড়িয়া, খর্ণিয়ার রাজার সংলগ্ন এলাকা ও রানাই গ্রাম অঞ্চল, রুদাঘরার শোলগাতিয়া, চহেড়ার গেট ও ডুমুরিয়া সদরের ট্রলারঘাট এলাকা। এরমধ্যে উপজেলা সদরের আইতলা জেলেপল্লী, ট্রলারঘাট এলাকায় জোয়ারের পানি ওঠানামা করছে।
ইউপি সদস্য শেখ মাহাবুর রহমান বলেন, গত ২-৩ দিন ধরে নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় লোকজন নিয়ে বাঁধ দিয়ে কোন রকমে পানি আটকাতে পেরেছি। তবে পারাপারের জন্য বাঁশের শাকোটি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। শোভনার বাদুরগাছা-বাগআঁচড়া নিয়ে ইউপি সদস্য দেবব্রত সরদার বলেন, এখানকার রক্ষাবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। যেকোন সময় বাঁধ ভেসে যেতে পারে।
শরাফপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম রবি বলেন, ইউনিয়নের চাঁদগড়, জালিয়াখালি, বৃত্তিবিড়ালা, আসাননগর এলাকার অবস্থা মোটেই ভালো না। বাঁধ ছুঁই ছুঁই জোয়ারের পানি।
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীতে ইয়াসের প্রভাবে ১৬ গ্রাম প্লাবিত
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ইয়াসের প্রভাবে ডুমুরিয়া উপজেলার কোথাও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে উপজেলার অভ্যন্তরীন নদী গুলোতে জোয়ারের পানির প্রচণ্ড চাপ রয়েছে।