কোভিড চিকিত্সার সুবিধা
মানুষের জীবন সর্বাগ্রে: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী কঠোর লকডাউনের সময় সবাইকে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুসরণ এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাঙালি নববর্ষের প্রাক্কালে পহেলা বৈশাখের ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে মানুষের জীবন সর্বাগ্রে। বেঁচে থাকলে আবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে পারব।’
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনগুলো এই ভাষণ একযোগে সম্প্রচার করে।
তিনি কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান এবং আশ্বাস দেন যে তার সরকার সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে। তিনি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
প্রায় ১৩ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গত সপ্তাহে জনগণের চলাচলে কিছুটা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার।
তিনি বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের পর সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেন যে কঠোর পদক্ষেপের ফলে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিনি সকলকে মনে করিয়ে দেন যে মানুষের জীবন রক্ষা করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
গত বছর করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর আমাদের নানাবিধ বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মহামারি প্রতিরোধে যেহেতু মানুষের সঙ্গ-নিরোধ অন্যতম উপায়, সে জন্য আমাদের এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছে যার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর প্রভাব পড়েছে।’
চারটি মূল নীতি
তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা একটানা ৬২ দিন সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। আমরা এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারিনি। বিদেশের সাথে চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এই অবস্থা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের যেখানেই এই মরণঘাতী ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে, সেখানেই এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতি, মানুষের জীবন-জীবিকা যাতে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে না পড়ে সেদিকে আমরা কঠোর দৃষ্টি রাখছি।
‘সকলের সহযোগিতায় আমরা বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলাম যার ফলে গত বছর করোনাভাইরাস মহামারিজনিত প্রভাব আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি,’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির উপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর আমরা চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করেছিলাম।
চারটি কার্যক্রম হচ্ছে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কর্মসৃজনকেই’ প্রাধান্য দেয়া; আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা; (সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।
তিনি বলেন, এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে আমাদের কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।
‘শঙ্কিত হবে না’
তিনি বলেন, কলকারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন উত্পাদন এবং কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেয়া ছাড়াও প্রায় আড়াই কোটি লোককে বিভিন্ন সরকারি সহায়তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে।
‘আপনাদের শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। সরকার সব সময় আপনাদের পাশে রয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আমি দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষদের সহায়তার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি,’ বলেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে পল্লী অঞ্চলে কর্মসৃজনের জন্য ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসছে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৬৭২ কোটিরও বেশি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। এর দ্বারা দেশের প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার নিম্নবিত্ত পরিবার উপকৃত হবেন। গত বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৫৬ লাখ লোক প্রথম ডোজ পেয়েছে
করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস মোকিবিলায় ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
‘ইতোমধ্যেই ৫৬ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। যারা প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে দেশের সকলকে টিকার আওতায় নিয়ে আসবো। আমাদের সে প্রস্তুতি রয়েছে,’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন:মহামারিতে বৈশ্বিক শান্তি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে: প্রধানমন্ত্রী
তবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে তবে টিকা দিলেই একজন সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত হবেন এমন নিশ্চয়তা নেই বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। কাজেই টিকা নেয়ার পরও আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
কোভিড চিকিত্সার সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলায় করোনাভাইরাস রোগীর চিকিৎসা সুবিধার আওতা আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইসিইউ সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের সবাইকে সাবধান হতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আমাদের নিজের, পরিবারের সদস্যদের এবং প্রতিবেশির সুরক্ষা প্রদানের। কাজেই ভিড় এড়িয়ে চলুন। বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন। ঘরে ফিরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে গরম পানির ভাপ নিন।’
শেখ হাসনা বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে ১৮-দফা নির্দেশনা জারি করেছে। আমরা যদি সকলে করোনাভাইরাস মোকাবিলার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, অবশ্যই এই মহামারিকে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ।’
‘পহেলা বৈশাখ ডিজিটালভাবে উদযাপন করুন’
তিনি বলেন, যুগে যুগে মহামারি আসে, আসে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। এসব মোকাবিলা করেই মানবজাতিকে টিকে থাকতে হয়।
জীবনের চলার পথ মসৃণ নয়। তবে পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের তা জয় করে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় তাই বলতে চাই:
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি’ পচা অতীত
গিরি গুহা ছাড়ি’ খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর বীর্যবান
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান।
তিনি বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। নানা প্রতিকূলতা জয় করেই আমরা টিকে আছি। করোনাভাইরাসের এই মহামারিও আমরা ইনশাআল্লাহ মোকাবিলা করব। নতুন বছরে মহান আল্লাহর দরবারে তাই প্রার্থনা, বিশ্বকে এই মহামারির হাত থেকে রক্ষা করুন।
প্রধানমন্ত্রী এ বছর একই দিনে বাংলা নববর্ষ এবং পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানা।
তিনি সবাইকে ঘরে থাকতে বলেন।
‘আগের বছরের মতো, বাঙালিদের ঘরে বসে ডিজিটাল মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উত্সব উদযাপন করতে হবে,’ বলেন তিনি।
৩ বছর আগে