মায়া রানী
বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির পর মাথা গোজার ঠাঁই পেলেন মায়া রানী
বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির পর এবার মাথা গোজার ঠাঁই পেলেন অসহায় বীরাঙ্গনা মায়া রানী সাহা (৭০)।
ফরিদপুর বর্ধিত পৌরসভার শোভারামপুর এলাকার বাসিন্দা নিঃসন্তান মায়া রানীর বসবাসের কোন ঘর না থাকায় খুব কষ্টে দিনপাত করছিলেন তিনি। মায়া রানীর দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার তার থাকার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন।
শনিবার দুপুরে বীরাঙ্গনা মায়া রানী সাহার ঘরের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম রেজা। এ সময় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজ বাড়িতে ১৬ বছর বয়সে হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন মায়া রানী সাহা। স্বীকৃতি কিংবা ভরসার জায়গা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে অসহায়ভাবে জীবন যাপন করছিলেন তিনি। খবর পেয়ে গণশুনানির সময় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের সাথে সাক্ষাত করেন তিনি। তখনি তার অসহায়ত্বতার কথা জানান জেলা প্রশাসককে।
তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসক মায়া রাণী সাহার বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামতসহ জামুকায় প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য ফরিদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. মাসুম রেজাকে নির্দেশনা প্রদান করেন।
সেই নির্দেশনার আলোকে গত বছরের ১৪ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে উপজেলা বীরাঙ্গনা যাচাই বাছাই সংক্রান্ত গঠিত বিশেষ কমিটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জামুকা বরাবর প্রেরণ করেন। তারই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে মায়া রাণী সাহাকে ৩৮০ নং গেজেটে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
এদিকে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তার ছিল না কোনো থাকার ঘর। মায়া রানী সাহার জরাজীর্ণ আবাসস্থল সেমি পাকা ভবনে রূপান্তরে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন জেলা প্রশাসক অতুল সরকার। ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একটি সেমি পাকা ঘর নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে মায়া রানী সাহার জরাজীর্ণ বসত ভিটায়।
ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম রেজা বলেন, 'ফরিদপুরে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পাঁচজন বীরাঙ্গনা রয়েছেন। এদের প্রত্যেককে একটি করে ঘর নির্মাণ করে দেবে সরকার। মায়া রানীর থাকার জায়গা না থাকায় একটু আগে ভাগেই আমরা ডিজাইন ঠিক রেখে তাকে একটি ঘর তৈরি করে দিচ্ছি জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে।'
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরো জানান, মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত সকল গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য আবাসস্থল নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসন বীরাঙ্গনা মায়া রানী সাহাকে এই ঘরটি মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে প্রদানের ব্যবস্থা নিয়েছে।
মাসুম রেজা জানান, জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা রয়েছে, 'জেলার যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা আবাসস্থলের কষ্টে আছেন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অনুকুলে ঘর বরাদ্দের পূর্ব পর্যন্ত তারা সম্মত থাকলে তাদেরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পে পূনর্বাসন করতে । আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।'
মাথা গোজার ঠাঁই পেয়ে খুশি বীরাঙ্গনা মায়া রানী সাহা। তিনি জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, 'এমন ভালো মানুষ আর হয় না। তার কারণে আমার নাম তালিকায় উঠেছে। বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছি। এবার ঘর পেলাম।'
তিনি বলেন, 'আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্না করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। সামনের দিনে আর হয়তো এই কাজ করতে হবে না। জীবনের শেষ বয়সে এই স্বীকৃতি আমাকে অনেক বেশি শক্তি জোগাবে বাচাঁর'।
পরে মায়া রানীর হাতে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আলু, ২ কেজি তেল, লবন সহ নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী হাতে তুলে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এর আগে করোনাকালীন সময়ে জেলার মধুখালীতে দু’জন ও ভাঙ্গা উপজেলায় একজন বীরাঙ্গনার অসুবিধার কথা জানতে পেরে তাদের পাশে দাড়ান জেলা প্রশাসক অতুল সরকার। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ওই দুই উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় খাদ্য সামগ্রী।
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিম উদ্দিন ও ভাঙ্গা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সজীব আহমেদ সহ কর্মকর্তারা বীরাঙ্গনা দেবী আরতি রানী ঘোষের গ্রামের বাড়ি চান্দ্রা ইউনিয়নের মালিগ্রামে যান। এ সময় তার হাতে উপহার ও খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন ইউএনও।
এদিকে মধুখালীতেও করোনাকালীন সময়ে বীরাঙ্গনা আম্বিয়া বেগম ও মোছা. ফুলজান বেগমের দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে তাদেরকেও সহায়তা প্রদান করেন জেলা প্রশাসক অতুল সরকার। তার নির্দেশে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তফা মনোয়ার তাদের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দেন।
অপরদিকে ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে অবর্নণীয় শারিরীক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন চারুবালা বিশ্বাস। হানাদার বাহিনী চারুবালার স্বামী ও দুই মাসের কোলের সন্তানকে হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
বিষয়টি জানতে পেরে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার তাৎক্ষনিকভাবে চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরেজমিন গিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেন। ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ইউএনও এর পক্ষ থেকে। সেই প্রতিবেদন সহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি নিয়ে চারুবালা বিশ্বাসকে নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছেন জেলা প্রশাসক অতুল সরকার।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ফরিদপুর বর্ধিত পৌরসভার শোভারামপুর এলাকার বাসিন্দা নিঃসন্তান মায়া রানীকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি প্রদানে সহায়তা করা হয়েছে। বসবাসের কোন ঘর না থাকায় খুব কষ্টে দিনযাপন করছিলেন তিনি। মায়া রানীর দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে তার থাকার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'করোনাকালীন সময়ে জেলার আরো তিনজন বীরাঙ্গনা অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছিলেন এমন খবর পেয়ে তাদের পাশে দাড়িয়েছে জেলা প্রশাসন। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী। জেলা প্রশাসন সব সময় অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছে, ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে।'
৩ বছর আগে