হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা
মিতু হত্যা: বাবুল আক্তার ৫ দিনের রিমান্ডে
চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যা মামলায় তার স্বামী সাবেক পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সরোয়ার জাহানের আদালতে তোলার পর তাকে রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।
বাবুলের আইনজীবী আনিসুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বুধবার মিতুকে হত্যার অভিযোগ তুলে বাবুল আকতারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। এতে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে মিতুকে হত্যার অভিযোগ আনেন তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বাবুল আক্তারকে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সাথে আগের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কিলিং মিশনের সদস্য মুসা, কালু, অস্ত্র সরবরাহকারী এহেতাশামুল ভোলা, তার সহযোগী মুনীর, মোটর সাইকেল সরবরাহকারী সাইদুল আলম সিকদার ওরফে সাক্কু, শাহজাহান, আনোয়ার এবং ওয়াসিমকে আসামি হিসাবে রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়েছে পিবিআই
বাবুল আকতারের নির্দেশে মুসা এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার পাশাপাশি কিলিং মিশনের নেতৃত্ব দিলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তার খোঁজ পায়নি। আরও দু’জন আগেই পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতার চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় মুসা ছিল তার বিশ্বস্ত সোর্স। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার তাকে ফোন এবং এসএমএস দিয়েছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে পিবিআই।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভূঁইয়া জানান, আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় তার স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আকতারসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, মিতু হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ জন্য নতুন একটি মামলায় তাকে আসামি করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা
রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘মিতু হত্যায় বাবুল আকতারের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। তবে আইন অনুযায়ী পুলিশ চাইলেই মামলার বাদীকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। তাই আমরা আজ তদন্তাধীন মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করব।’
ব্রিফিংয়ের পরপরই চট্টগ্রাম আদালতে বাবুল আকতারের করা মামলার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পিবিআই। পিবিআই চট্টগ্রামের উপপরিদর্শক আজমির হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।
এর পর পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করতে পৌঁছান মিতুর বাবা মোশাররফ।
পিবিআই জানায়, মিতু হত্যায় বাবুলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে এরই মধ্যে বাবুলের দুই বন্ধু গাজী আল মামুন ও সাইফুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
আরও পড়ুন: মিতু হত্যা: বাবুল আক্তার ৫ দিনের রিমান্ডে
থানায় মামলা করতে আসা বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, যে কারণে বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে সেই কারণে আমিও চট্টগ্রামে। আমার মেয়ের খুনের সঙ্গে বাবুল আক্তার যে জড়িত সেটা আগেই আমি উত্থাপন করেছিলাম।
মঙ্গলবার রাতে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নেয়ার কথা জানায় পিবিআই। এর আগে দুপুরে চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমাসহ পিবিআইয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ের কাছে ওআর নিজাম রোডে নির্মমভাবে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ছুরিকাঘাত ও গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাচঁলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মিতু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কারণ তার স্বামী বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে এএসপি থাকাকালে জঙ্গি বিরোধী অপারেশনে পুলিশের প্রথম সারির কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাবুল আক্তার ও মিতুর পরকীয়ার বিষয়টিও আলোচিত হয় গণমাধ্যমে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্যও নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
হত্যাকাণ্ডের বছরখানেক পর থেকেই মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছিলেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে তার মেয়ে মিতুকে খুন করা হয়েছে।
মিতু হত্যাকাণ্ডের পর একটি মাজারের খাদেম আবু নছর ওরফে গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিন নামের আরও এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে তারা জামিনে বেরিয়ে আসেন। হত্যকাণ্ডের ২০ দিন পর তদন্ত ভিন্নখাতে মোড় নেয়।
২০১৬ সালের ২৪ জুন মধ্যরাতে ঢাকার বনশ্রী এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। পরে তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর নানা গুঞ্জন ডালপালা ছড়ায়।
এসময় পুলিশ জানায়, বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন বাবুল আক্তার।
তবে বাবুল আক্তারের দাবি ছিল, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন তিনি। নানা নাটকীয়তা শেষে ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মিতু হত্যার ২১ দিন পর ২৬ জুন গ্রেপ্তার করা হয় ওয়াসিম ও আনোয়ারকে। আদালতে জবানবন্দি দেন তারা। এরপর বেরিয়ে আসে হত্যায় জড়িতদের তথ্য। জবানবন্দিতে তারা জানান মুছার নেতৃত্বে ওয়াসিম, আনোয়ার, মো. রাশেদ, নবী, মো. শাহজাহান ও মো. কালু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে ছিলেন ওয়াসিম, মুছা ও নবী। মাহমুদাকে ছুরিকাঘাত করেন নবী। অস্ত্র সরবরাহ করেন এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা।
তবে কী কারণে, কার নির্দেশে তারা হত্যায় অংশ নিয়েছেন তা নিয়ে কোন তথ্য দেননি। একই বছরের ৪ জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নবী ও রাশেদ। মুছা ও কালুকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এক পর্যায়ে মুছাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ।
২০১৬ সালের ২২ জুন চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পুলিশ মুছাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে দাবি করে আসছেন তার স্ত্রী পান্না আক্তার। এ অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে পুলিশ।
৩ বছর আগে