সৈয়দ মুজতবা আলী
সমীরুদ্দী ও মুনিয়ারা-একই সমতলে
ছোট বেলায় শুনতাম অমুক গ্রামের তমুকে জাহাজে চাকরি নিয়েছে। শিগগিরই যোগ দেবে। সইন দিয়েছে। সইন জিনিসটা কি অনেকদিন বুঝিনি। তবে এটা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের কোনো শর্তনামা বলে ধরে নিয়েছিলাম।
জাহাজে চাকরি থেকে যারা ছুটিতে আসেন তারা বিস্কুট, শুকনা ফল, কাপড়-চোপড় নিয়ে আসেন। পকেট ভর্তি টাকাতো আছেই। কাছাকাছি আত্মীয়, অনাত্মীয় হলে কিছু ভাগও দেয়া হতো। তখনকার চাকরি ও নগদ টাকা খুব লোভনীয় ব্যাপার ছিল। ওই সময়ে আর্মি নেভিতে যোগ দিলেও বলা হতো সইন দিয়েছে। জাহাজ ভর্তি করে তারা নীল দরিয়া দিয়ে করাচি পাড়ি দেয়। আঙ্গুরের দেশ।
সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প নোনাজল পড়তে গিয়ে সইন সম্পর্কে জানলাম। এটা ছিল (sign) এই সাইনকেই সইন বলা হতো।
নোনাজলের মূল চরিত্র ছিল সমীরুদ্দী নামের এক খালাসির। ৬ ফুটের অধিক দৈর্ঘ্য, পেটানো শরীর, বাঘের থাবার ন্যায় হাতের শক্তি এবং আরও অনেক বিশেষণের অধিকারী এই সমীরুদ্দী। বাড়ি সিলেট।
সইন দিয়ে যারা এসব চাকরি নেয় তারা জানে কাজটা কত কঠিন, কত মানবেতর। টাকা পয়সা ও গিফট যারা আশা করেন তারা কখনোই জানে না এই নরক পরিবেশের কথা। সমীরুদ্দী নিজ দায়িত্বে একনিষ্ঠ। বাহুল্য খরচ করে না, জাহাজ ভিড়লে গনিকালয়ে দৌড়ায় না। এমনকি ভেগে যাওয়ার সুযোগ এলেও যায় না।
চাকরি পাওয়া ছেলেগুলো জাহাজের বয়লারে কয়লা নিক্ষেপ করে। গনগনে কয়লার উত্তাপ, চারিদিকে অন্ধকার, কি এক কঠিন জীবন। মাঝে মাঝে তারা পাগল হয়ে যায় এবং এক দৌড়ে বয়লার রুম ছেড়ে ওপরে উঠে যায়, সাগরে ঝাঁপ দেয়ার জন্য। কেউ পথ আগলালে তাকে খুন করতেও দ্বিধা করেনা। তখন সবাই তাকে ধরে পানিতে চুবিয়ে রাখে। এটাকে এমখ (Amuck) বলে। সমীরুদ্দী কখনো এ কাজ করেনি। শক্ত মনোবলের পরিচয় দিয়ে সে সবখানে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।
কোনো কোনো পোর্টে জাহাজ থামলে নামতে দেয় আবার কোনো পোর্টে কড়াকড়ি। আমেরিকার কোনো পোর্টে কাউকে নামতে দেয়া হয় না যাতে কেউ পালাতে না পারে। নিউইয়র্ক পোর্টে একবার জাহাজ থামলো মূল বন্দর থেকে একটু দূরে।
সমীরুদ্দী সিদ্ধান্ত নিল সে পালাবে। বহু আগে থেকেই সে স্বদেশিদের সাথে পত্রালাপ করে পরিকল্পনা করে রেখেছিল যা দ্বিতীয় কেউ জানে না। আজ সুযোগ কাজে লাগাবে।
একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীকে ব্যাপারটা জানাল। সাহায্য হিসেবে একটা বড় ডেকচি চেয়ে নিল। সন্ধ্যার পর সমীরুদ্দী কলকাতা চোরা মার্কেট থেকে কেনা সুট টাই জুতা ডেকচিতে রেখে ঝুপ করে পানিতে ফেলে দিল। পরে নিজে ঝাঁপ দিল। প্রায় আধা ঘণ্টা সাতরিয়ে পাড়ে উঠল। সুট বুট পরে ডাঙায় নেমে গেল। ডেকচি পানিতে ডুবিয়ে দিল।
সমীরুদ্দী টাকা কামানোর জন্য আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল। অনেক টাকা কামালো। সময়ে সময়ে টাকা বাড়ি পাঠালো ছোট ভাইয়ের কাছে। থাকার জন্য একটা দালান, বাড়ির সামনে লন, পুকুর পাড়ে একটি মসজিদ যার উঁচু মিনার গ্রামের দিগন্ত ছুঁয়ে যাবে। নকশাও পাঠিয়ে দিয়েছে। এসব নির্মাণ হয়ে গেছে ভাইয়ের চিঠি পেয়ে দেশে রওনা দিল।
স্টেশনে নেমে সমীরুদ্দী গ্রামের পথে হাটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে তাকায়, মসজিদের মিনার যদি দেখা যায়? বাড়ির কাছে এসে গেছে। কোনো ইমারত নজরে আসছে না। মসজিদ মিনার কিছুই নেই। অজানা শংকা তাহলে কি তার পাঠানো টাকায় কিছুই নির্মিত হয়নি? ছোট ভাই স্টেশনেও আসেনি। গ্রামের মসজিদে ফজরের নামাজে দু একজন মুসল্লি এসেছেন। তাদের কাছে জানা গেল তার ছোট ভাই সমীরুদ্দীর পাঠানো টাকায় আনন্দ ফূর্তি করেছে।
মন খারাপ করে সমীরুদ্দী আবার আমেরিকা পাড়ি জমায়। বেশিদিন থাকতে পারেনি। বয়স হয়েছে। দেশ টানছে। ফেরার পথে জাহাজে প্রাণ ত্যাগ করে। পকেটে ২১ হাজার টাকা ছিল। উত্তরাধিকার হিসেবে ছোট ভাই এ টাকাটাও পেল।
আমাদের দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরও একই পরিণতি। মরুভূমির উত্তাপে দগ্ধ হয়ে দেশে ফিরে আসার পর অনেকেই স্ত্রী, মা বাবাকে হারিয়ে ফেলেন। কামাই করা টাকার কোনো হদিস নেই। ফ্ল্যাট জমিজমা যা কেনা হয়েছে বলা হয়েছিল তার কোনো চিহ্ন নেই। প্রবাসী মহিলা কর্মীরা নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে লাশ হয়ে কিংবা শূন্য হাতে ফিরে আসেন । সংসারের অভাব ঘুচাতে কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কিশোরীরা পথে নামে। স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে সিরির প্রতি ধাপেই ওরা নির্যাতিত হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের কাফনের কাপড়ও কেনার অর্থ থাকে না। সমিরুদ্দী, মুনিয়া, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের চূড়ান্ত পরিণতি একই সমতলে।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: বীরের খেতাব হরণ
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
৩ বছর আগে