জেনারেল জিয়া
বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারের বিদায়
১৯৭৫ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে কেনো জানি কুমিল্লা চলে এলাম। মাসিক হাত খরচের ১৫০ টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হল থেকে বাড়ি চলে আসি। কিছু সঞ্চয় আর নুতন মাসের টাকা নিতে মাঝে মাঝেই বাড়ি যাওয়াটা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা কুমিল্লার বাস ভাড়া ছিল চার টাকা, চারটি ফেরি। সময় চার ঘণ্টা।
এবার ঢাকা ছেড়ে এসে ৭ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু মিস করেছি। এ বছরের রাজনীতি ও সরকারের মাঝে অনেক পরিবর্তন, অনেক গুঞ্জন, গুজব, নানা কাহিনী সবার মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী মুশতাক গংদের সামরিক শাসনের বিষয় ছিল উল্লেখযোগ্য।
৩ নভেম্বর ঘটে গেল চার নেতার জেল হত্যার হৃদয় বিদারক ঘটনা। অবিশ্বাস্য, যারা ত্যাগ ও বিশ্বস্ততার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাদের এই হত্যাকাণ্ড জনগণ সমর্থন করেনি। এর সাথে ঘটেছিল খন্দকার মুশতাকের বঙ্গভবন ত্যাগ ও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিদেশে পলায়ন।
এরপর মেজর জেনারেল জিয়াকে (তৎকালীন সেনাপ্রধান) অন্তরীণ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ) স্বঘোষিত মেজর জেনারেল পদবি ধারণ করে সেনাপ্রধানের পদ গ্রহণ করেন যা তার উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কোন আদেশের বলে তিনি পদ ও পদবি নিজেই গ্রহণ করেছিলেন তা আজও অজানা। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে খালেদের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ এমপি মিছিল বের করে যা ভারতীয়দের প্রতি সমর্থন বলে প্রচার পায়। জনগণের ধারণা আবার বুঝি বাকশাল ঘুরে এলো।
সামরিক বেসামরিক মহলে জিয়াউর রহমান একজন জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার অপসারণ ও অন্তরীণ কেউ মেনে নিতে পারছিলনা। এর সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহের বীর উত্তম (অবসরপ্রাপ্ত) সেনা অফিসারদের ও সৈনিকদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত করেন। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে চাকরিরত সৈনিকদের মাঝে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হন। কর্নেল তাহের সেনা সদস্যদের উস্কিয়ে অফিসার হত্যার মত ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হন। বহু সেনা অফিসার সৈনিকের হাতে নিহত হন। এই ধারাবাহিকতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন। কর্নেল তাহের তথাকথিত সিপাহী জনতার বিপ্লব নামে রাজনীতির জল ঘোলা করে নিজের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টায় জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাকে মুক্ত করা হয়। জেনারেল জিয়ার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষী জিয়াকে তাহেরের নীল নকশার ফাঁদে পা দিতে দেন নি। ফলে কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জেনারেল জিয়া পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় ও সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সেক্টরের বীর যোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারের এই করুণ পরিণতি ঢাকা, কুমিল্লা ফরিদপুর, নোয়াখালী অঞ্চলের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। হানাদারের গুলি যাদেরকে স্তব্ধ করতে পারেনি তারা নিজ অফিসার ও সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। দু: সময়ের দিনগুলিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ করা শিখিয়েছিলেন, যারা নিজের বর্ণিল ক্যারিয়ার ত্যাগ করে পাকিস্তান রক্ষার শপথ ভেঙেছেন তারা আজ নিহত।
মুক্তিযুদ্ধকালে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও কে ফোর্স অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ। সেক্টরের গেরিলা কার্যক্রম পরিচালনায় ছিলেন মেজর হায়দার। নিয়মিত ও গেরিলা অপারেশনের সমন্বয়ে এই সেক্টর অভিযান পরিচালনা করতো। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতা গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতো মেজর হায়দারের তত্ত্বাবধানে। তাই সর্বস্তরের যোদ্ধারা মেজর হায়দারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অসম্ভব স্নেহ বৎসল, প্রয়োজনে কঠোর, অমায়িক, দুর্ধর্ষ কমান্ডো এই সেনা অফিসার খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। রাজধানী ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ তারই পরিকল্পনায় পরিচালিত হতো। তাই আত্মসমর্পণের পরও ঢাকা অপারেশন ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব মেজর হায়দারের উপর ন্যস্ত ছিল। আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষররিত হলে ঢাকা শহরের বিশৃঙ্খলা ব্যাপক হয়ে ওঠে। তখন মেজর হায়দার টিভি ও বেতারে বার বার শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার জন্য নাগরিকদেরকে সতর্ক করেন। লুটপাট, খুন শক্ত হাতে দমনের জন্য গেরিলা ইউনিট সমূহকে নির্দেশ দেন।
দেশ স্বাধীনের পর সবাই যার যার কর্মে ফেরত যায়। তেমনি মিলিটারি ও তাদের কর্তব্যে নিয়োজিত হয়। অনেক দিন হায়দার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি। জানতাম না কে কোথায় আছে।
১৬ ডিসেম্বর ৭১ এর বিজয়ের পর সবাই ভারত ছেড়ে স্বাধীন দেশে ফেরা শুরু করে। আমি আমার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ছিলাম। একদিন কুমিল্লায় মা বাবার সাথে দেখা করতে বাড়ি এলাম। বাসার প্রবেশ পথে দেখলাম একজন মুরুব্বী বসে আছেন। এ সময় সাধারণত আমার বাবা এখানে বসতেন। উনাকে চিনলাম না। সালাম দিয়ে বাসার ভেতরে দেখলাম একজন অতিথি ভদ্র মহিলাও বাসায় আছেন। জানতে পারলাম উনারা মেজর হায়দারের পিতা মাতা। ভারত থেকে এসেছেন। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার যাত্রাপথ ঠিক হলেই কুমিল্লা থেকে রওনা দেবেন। আমার বাবা মা ও উনারা ভালোই সময় কাটাচ্ছেন।
৩ নভেম্বর জেল হত্যা ও অন্যান্য ঘটনা অলিতে গলিতে আলোচনার বিষয়। নানান জনের নানা মত। নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
বাহার উদ্দিন রেজা বীর প্রতীক ও জামাল উদ্দিন বীর প্রতীক থেকে জানা গেল যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারের সাথে তাদের দেখা হয়েছে কুমিল্লার চৌয়ারাতে। বাহার ও জামাল কুমিল্লা থেকে একটা বাইকে চৌদ্দগ্রাম যাচ্ছিলেন। পথে আরেকটি বাইক চট্টগ্রামের দিকে থেকে কুমিল্লা যাচ্ছে। দুটি বাইক একে অপরকে অতিক্রম করতেই জামাল ও বাহার অপরদিক থেকে আসা আরোহীকে চিনে ফেললো। তিনি হায়দার ভাই। জামাল ও বাহার ছিল কুমিল্লা গেরিলা ব্যাচের বিশ্বস্ত যোদ্ধা। তাই তারা ছিল কর্নেল হায়দারের একান্ত আপনজন।
মোটর বাইক আরোহীরা বাইক ঘুরিয়ে একে অপরের সাথে কথা বললেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার বান্দরবান জেলার রুমা গ্যারিসন এ ৮ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটিতে ঢাকা যাচ্ছেন। ট্রেনের অপেক্ষা না করে মোটর বাইকে ঢাকা রওয়ানা হয়েছেন। তিনি খালেদ মোশারফ ও জেনারেল জিয়ার মাঝের ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে কাজ করে যাবেন বলে হায়দার ভাই জানালেন।
কথা শেষে কর্নেল হায়দার ঢাকা অভিমুখে রওনা দিলেন।
সারাদেশ নভেম্বরের শুরু থেকেই হতাশ। কেউ জানেনা কি হবে, কি হচ্ছে। জেল হত্যা, খন্দকার মুশতাক এর প্রস্থান, সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের অন্তরীণ, খালেদ মোশাররফের জেনারেল পদে পদোন্নতি ও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংগঠন এর সেনাবাহিনী ধ্বংসের চেষ্টা ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা এবং কর্নেল হায়দারের হত্যাকাণ্ড আরও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকার বাইরে আমরা নানাবিধ সংবাদ পাচ্ছিলাম। ৭ নভেম্বর রেডিও টিভি থেকে সংবাদ পরিবেশিত হলো যে সিপাহী জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেছে। প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার শের ই বাংলা নগরে ১০ ই বেঙ্গলের সেনা সদস্যরা হত্যা করেছে। গুলির পর বেয়নেট চার্জ করতেও ছাড়েনি।
রাস্তায় রাস্তায় বিজয় উৎসব চলছে। ট্যাঙ্ক এর লম্বা ব্যারেল এ ফুলের মালা ঝুলছে। সেনাদেরকে জনতা অভিনন্দন জানাচ্ছে। এক উৎসব মুখর ঢাকা নগরী।
কর্নেল হায়দারের মৃত্যু সংবাদ আমাদেরকে খুব বিচলিত করে। কে রাজা হলো, কে ক্ষমতায় গেল তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আমাদের প্রিয় গেরিলা কমান্ডার হায়দার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে আমরা মেনে নিতে পারছি না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও আমাদের কমান্ডার ছিলেন। তবে জনযোদ্ধারা কর্নেল হায়দারের সাথেই সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলেই তিনি অধিক পরিচিত।
আমরা কয়েকজন ঢাকা গিয়ে কর্নেল হায়দারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সিদ্ধান্ত নিলাম। বাহার, জামাল ও আমি ঢাকা চলে এলাম। সূর্যসেন হলের আমার ৪২৬ নম্বর কক্ষে আরও কয়েকজন এলো, সবার নাম এখন মনে পড়ছে না। কর্নেল হায়দারের লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার দাফনের কি ব্যবস্থা হচ্ছে কেউ জানে না। চলাচলও সীমিত। সন্ধ্যার পর কারফিউ। সেনানিবাসে প্রবেশে কড়াকড়ি।
সন্ধ্যার আগেই মতিঝিল কলোনিতে পৌঁছে গেলাম। খুঁজে বের করলাম কর্নেল হায়দারের বড় বোনের বাসা। শোকাহত পরিবেশ। হায়দার ভাইয়ের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি এখনো। চেষ্টা চলছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই তিন জন বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের মর্গে আছে। ৭ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত লাশের কোনো সন্ধান কেউ পায়নি। তবে এর মাঝে কর্নেল হায়দার হায়দারের লাশ ব্যতীত বাকিদের লাশ আত্মীয় স্বজনরা আগেই নিয়ে গেছে।
লাশ সংগ্রহ করে গোসল করিয়ে মতিঝিলের বাসায় আনা হলো। এরপর লাশের ট্রাকে করে আমরা কিশোরগঞ্জ রওনা হলাম। তাকে তার নিজ বাড়িতে দাফন করা হবে।
কর্নেল হায়দার ছুটি কাটাতে এসে তার মুক্তিযুদ্ধ কালীন কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করতে গিয়ে নির্দোষ প্রাণটি হারালেন।
১২ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কর্নেল এটিএম হায়দার নিজ বাড়ির আঙিনায় সমাহিত হলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, মুক্তিযোদ্ধা ও গুণগ্রাহীদের ভালোবাসা নিয়ে চিরবিদায় নিলেন।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
আরও পড়ুন: সমীরুদ্দী ও মুনিয়ারা-একই সমতলে
বীরের খেতাব হরণ
আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রসঙ্গ কথা
২ বছর আগে