স্বপ্ন শিল্পী
ফরিদা হোসেন: বাংলা সাহিত্যের এক স্বপ্ন শিল্পী
মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন
গুণমুগ্ধ ও ভক্তদের কাছে তিনি ফরিদা আপা হলেও তাঁর পুরো নাম ফরিদা হোসেন। প্রতিভা তাঁর বহুমুখী - সৃষ্টির আনন্দে তিনি সুখী। কি গল্প লেখায়, কি উপন্যাস লেখায়, কি নাটক লেখায়, কি গান রচনায়, কি সুরারোপে, কি আবৃত্তিতে, কি সংগঠক হিসেবে, কি সাহিত্যপত্র সম্পাদনায়, কি সমাজসেবায় - সকল ক্ষেত্রে তাঁর সমান ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তাঁর কাছে জীবনে থেমে যাওয়া বলে কিছু নেই। ঝর্ণার মতো চলাই তাঁর ছন্দ, চলাতেই আনন্দ। বয়সে তিনি প্রবীণ হলেও সৃজনে-মননে তিনি অরুণ রাঙা তরুণদের সমান বয়সী।
তাঁর জন্ম ১৯ জানুয়ারি কলকাতায়। তাঁর বাবার নাম ফয়েজ আহমেদ এবং মায়ের নাম বেগম ফয়েজুন্নেসা। তাঁর বাবা ছিলেন আইনবিদ এবং উপমহাদেশের শ্রম আন্দোলনের পথিকৃত। তাঁর পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার শায়েরখালি গ্রামে। পাঠ্যাবস্থা থেকে প্রতিভাবান ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে ছাত্রী থাকা অবস্থায় পাইওনিয়ার পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর গল্পগ্রন্থ 'অজান্তা', যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ও টিভি ব্যক্তিত্ব মোস্তফা মনোয়ার। গল্প, উপন্যাস ও নাটক মিলে এ পর্যন্ত তার ৪০টির মতো বই প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৪ সালে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংগঠন পেন বাংলাদেশ শাখার সভাপতি ছিলেন। পেন-এর আমন্ত্রণে পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেন তিনি। পেন ছাড়াও বাংলা একাডেমি (জীবন সদস্য), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ (সহ-সভানেত্রী ও জীবন সদস্য), আঞ্জুম শিশু কল্যাণ সংস্থা (প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী), গুলশান লেডিস কমিউনিটি ক্লাব (সদস্য), গুলশান ক্লাবসহ বিভিন্ন ক্লাব , সংগঠন ও সেবামূলক সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। 'অবিনশ্বর' নামে যে একটি সাহিত্যপত্র দীর্ঘকাল থেকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে, তিনি তার সূযোগ্য সম্পাদক। যখন তিনি কথা বলেন, মিরসরাইয়ের মেয়ে হলেও উচ্চারণে আঞ্চলিকতার কোনো আছর তার মধ্যে মোটেও পরিলক্ষিত হয় না। মনে হয়, উচ্চাঙ্গের উচ্চারণে কেউ বাংলাভাষার আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁর মুখের ভাষা বেশ মোলায়েম ও মধুর এবং সর্বোপরি তিনি একজন মানবিক গুণসম্পন্ন মননশীল মানুষ।
আরও পড়ুন: বিটিভির মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের উদ্যোগ
২০১৮ সালের দিকে আমার মেয়ে আনিকা আঞ্জুমের পড়ালেখার প্রয়োজনে আমাকে নয় মাস থাকতে হয়েছিল ঢাকায়। মেয়ে তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএস-এ বিবিএ অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। যমুনা ফিউচার পার্কের সামান্য সামনে বাঁশতলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস। এর চট্টগ্রাম ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়ার কারণেই মেয়েকে ঢাকার ক্যাম্পাসে ভর্তি করাতে বাধ্য হই। তখন আমরা মিরপুর ২-এ সনি সিনেমা হলের পিছে থাকতাম আত্মার আত্মীয় শিহাবের পাঁচতলা ভাড়া বাসায়। মিরপুর থেকে বাঁশতলায় বাসে যাওয়া-আসা করাটা ছিল তখন আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। বাঁশতলার কাছাকাছি গুলশানে ফরিদা আপার বাসা। তিনি প্রায়ই তাঁর ব্যক্তিগত পিএস সেলিমকে পাঠাতেন আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যেতে। তেমনি একটি দিন ছিল ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট। মেয়েকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে সেলিমের সঙ্গে যাই ফরিদা আপার বাসায়। তখন সকাল সাড়ে দশটা কি এগারটা। বাসায় প্রবেশের পাঁচ মিনিট পরেই অতিথি কক্ষে আসেন ফরিদা আপা। সালাম বিনিময়ের পর প্রথমেই তাঁকে তাঁর প্রয়াত বাবার ওপর প্রকাশিতব্য পুস্তকের প্রুফ দেখা কপিগুলো দেই, যেগুলো তিনি আমাকে দিয়েছিলেন প্রুফ দেখে দিতে। এরপর উঠে আসে সৈয়দ আলী আহসানের ওপর 'অবিনশ্বর'-এর প্রকাশিতব্য সংখ্যাটির কথা, যেটির অতিথি সম্পাদক হওয়ার জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাকে। লক্ষ্য করেছি, সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে কিছু বলার সময় তাঁর অবয়বে আবেগ ও শ্রদ্ধার শুদ্ধ ও শুভ্র প্রকাশ। সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্যার আমাকে বলতেন, যেখানেই বাস করো না কেন, সেই স্থানকে যদি আনন্দের স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে পার, তবে কাজ করতেও আনন্দ পাবে, সাফল্য পাবে।’
আরেক স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, “একবার আমি ওমরা করতে যাবো, গিয়েছি আলী আহসান স্যারের বাসায়- তাঁর কাছ থেকে ওমরা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে। স্যার হেসে আমাকে বলেন, 'সবাই আসে আমার কাছে তদবির নিয়ে - কেউ চাকুরির তদবির নিয়ে, কেউ লেখা প্রকাশের তদবির নিয়ে। এই প্রথম কেউ এলো ওমরা সম্পর্কিত পরামর্শ নিতে।’ এরপর স্যার হাত তুলে আমার জন্য দোয়া করে দেন।"
এরই মধ্যে চলে আসে চা-নাস্তা। নিজের প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অজান্তা'র একটি আদি কপি দেখিয়ে তিনি বলেন, "তখন আমি ছিলাম প্রচারবিমুখ। নিজেকে আড়ালে রাখতাম সবসময়। আমার বিয়ের যিনি উকিল ছিলেন, তিনি ছিলেন আব্বার পূর্ব পরিচিত। তিনি একদিন আসেন আমাদের বাসায়। এসে কাছে ডাকেন আমাকে এবং বলেন, নিজেকে আড়ালে রাখলে প্রতিভা প্রকাশ পাবে কি করে?"
নিজের স্বামী মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন সম্পর্কে বলেন, "বিয়ের আগে তিনি আমার গল্পগ্রন্থ 'অজান্তা' পড়েছেন এবং সেটি সবসময় তাঁর বালিশের নিচে থাকতো। একদিন তিনি টিভি ভবনে যান তাঁর বন্ধু জাকিউদ্দীন আহমদকে নিয়ে। তখন টিভি ভবন ছিল ডিআইটি'তে। আমি তখন টিভি'র জন্য নাটক লিখতাম, পরিচালনা করতাম। আমার বড় ভাই ছিলেন তখন টিভি'র চীফ ক্যামেরাম্যান। আমি সেদিন নাটক নির্দেশনার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমাকে দেখে এসে পরে তারা মন্তব্য করেছিলেন - মেয়ে তো নয়, যেন আগুন!”
আরও পড়ুন: ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা’
তিনি আরও বলেন, "সেসময় আমি কাজের অবসরে এক জায়গায় বসে থাকতাম, হৈ-হুল্লোড় করা থেকে দূরে থাকতাম। কেউ এসে আমার পাশে বসলে, উঠে যেতাম ; ভাবতাম- পুরুষ কখনও ভালো হতে পারে না। পাশে বসার সুযোগ নিয়ে একসময় হাতের ওপর হাত রাখবে, তারপর বলে বসবে- আমি তোমাকে ভালোবাসি! পুরুষ সম্পর্কে তখন আমার ধারণা ইতিবাচক ছিল না।”
বিয়ের পরের দিনগুলো সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, "বিয়ের পর বহু স্ট্রাগল করতে হয়েছে আমাকে। দশ বছর পর্যন্ত তো কোনো লেখালেখিই করতে পারিনি! সংসার সামলাতে হয়েছে। শ্বাশুড়ি, দেবর, ননদ এবং নিকট আত্মীয়স্বজন সকলকে দেখতে হয়েছে আমাকে। কত কষ্ট যে করেছি, স্ট্রাগল করেছি, বলে শেষ করা যাবে না। শ্বশুর পক্ষের কোনো কোনো মহিলার উপহাসও শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি কিছু বলতাম না। চুপ থাকতাম। বিয়ের পর কেউ কেউ তো এমনও বলেছে - কি বউ আনলো ঘরে, কেঁচকি মাছও রাঁধতে জানে না। আমার বড় ভাই আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে চুপ থাকতে পারতেন না, প্রতিবাদ করতেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, সে কেঁচকি মাছ রাঁধতে জানে না - সেটাই শুধু তোমরা দেখলে, কিন্তু সে যে গল্প লিখে, গান লিখে, কবিতা লিখে, সেটা তোমাদের চোখে পড়ে না! দেখি, সে জাতীয় কিছু তোমরা নিজেরা লিখে দেখাও তো!"
নিজের স্বামীর সুনাম করতে গিয়ে ফরিদা হোসেন বলেন, "আমার স্বামী সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন, সব সংকটে সঙ্গে থাকতেন। তাঁর সহযোগিতা-সমর্থন ছাড়া আজ আমি এ পর্যায়ে পৌঁছতে পারতাম না। তিনি লেখালেখি করতেন না ঠিকই, কিন্তু ভালো সাহিত্য বুঝতেন। বিয়ের পর ব্যবসায়িক কারণে যখন করাচি থাকতেন, আমাকে না লিখলেও আমার বোনদেরকে চিঠি লিখতেন। পরে সেসব দেখিয়ে বোনেরা আমাকে বলতো, দেখ আপা, পড়ে দেখ, দুলাভাই কি সুন্দর ভাষায় চিঠি লিখেছেন!"
আরও পড়ুন: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী আজ
ফরিদা আপার সঙ্গে এরকম আরও একদিন আলাপ হয়েছিল তাঁর বাসায়। সেদিন ছিল ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর। সেদিন কথায় কথায় চলে আসে সৈয়দ রশিদ আহমদ জৈনপুরী (র.)-এর প্রসঙ্গ। জৈনপুরী (র.)-কে তিনি বাবা হুজুর বলে ডাকতেন। তাঁকে তিনি ও তাঁর স্বামী খুব শ্রদ্ধা করতেন। একবার জৈনপুরী হুজুরের সঙ্গে তিনি হজ্বেও গিয়েছিলেন। সে কাফেলায় বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. হারুন-উর-রশীদসহ আরও অনেকেই গিয়েছিলেন। সেই হজ্ব চলাকালীন সময় একদিন বাথরুমে পিছলে পড়ে প্রচুর ব্যথা পেয়েছিলেন ফরিদা আপা। পরদিন কাবা শরীফ তাওয়াফে যেতে পারবেন কিনা সংশয়ে ছিলেন। বাবা হুজুর তথা জৈনপুরী হুজুরকে ব্যথার কথা বললে তিনি রুম থেকে এনে কি একটা ওষুধ দেন ফরিদা আপাকে এবং খেতে বলেন। খেতে দিয়ে হুজুর বলেন, ইনশাআল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন। পরদিন সকালে ফরিদা আপা দেখেন তিনি পুরোপুরি ব্যথামুক্ত এবং দিব্যি হাঁটতে পারছেন। এবং তাওয়াফসহ হজ্বের যাবতীয় নিয়মকানুন পালন করতে পারছেন। নিজের অবস্থা দেখে আপা অবাক হয়ে যান! আরেকদিন আপা নাকি তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার সময় জৈনপুরী হুজুরকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেন। বাসায় গিয়ে দেখেন হুজুর ছাদের ওপর হাঁটাহাঁটি করছেন। একই ব্যক্তিকে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দু'জায়গায় দেখতে পেয়ে তিনি অবাক হয়ে যান! আপা জৈনপুরী হুজুরের বহু কেরামতির কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনান আমাকে।
উল্লেখ্য, এর দেড় দশক আগে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় হুজুরের ধারাবাহিক 'সংলাপ' পড়ে আমিও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, নিজের অজান্তে তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন ব্যক্তিগত এক ব্যাপারে আমি এতই বিক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত ছিলাম যে, কোনোমতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। হুজুরের একটি 'সংলাপ' পড়ে আমি শান্ত হয়ে যাই, শান্তি লাভ করি। সেই লেখাটি পড়ে আমার অন্তরের আগুন পানিতে পরিণত হয়। আমার কাছে তখন কেন জানি মনে হয়েছিল, দূর থেকে হলেও আমি তাঁর রুহানি ফয়েজ উপলব্ধি করতে পারছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে, লেখাটির উপশিরোনাম 'ক্রোধের আগুন ও বিনয়ের পানি'-এ জাতীয় কিছু ছিল। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায়। আজ সেসব স্মৃতিরা পোহায় রোদ্দুর।
আরও পড়ুন: কসমস আতেলিয়ার৭১ এর আয়োজনে 'আর্টিস্ট রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম'
২ বছর আগে