জবা ফুলের চায়ের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
জবা ফুলের চা: গুণাগুণ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও বানানোর পদ্ধতি
প্রকৃতি তার বিপুল উপাচার দিয়ে পরম যত্নে আগলে রেখেছে সমস্ত প্রাণীকুলকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির নেপথ্যে এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে প্রকৃতির উদ্ভিদ জগতের। এখনো এগুলোর উপযোগিতা বিস্ময়কর ভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। সৌন্দর্য্যের জন্য বহুল পরিচিত হলেও জবা ফুল ভেষজ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। জবা ফুলের চা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকে অনাক্রম্যতার জন্য গরম-ঠান্ডা দুইভাবেই পান করা হয়ে থাকে। উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদ্ভূত হলেও এখন অনেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলেও এই চা এর জনপ্রিয়তা আছে। জবা ফুলের লাল বা গভীর ম্যাজেন্টা রঙের বৃন্ত থেকে তৈরি করা হয় টক স্বাদযুক্ত এই চা। চলুন, জবা ফুলের চায়ের স্বাস্থ্যগুণ, ব্যবহার এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে জেনে নেয়া যাক।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জবা ফুলের চায়ের উপকারিতা
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
এই পানীয় উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের এবং হালকা উচ্চ রক্তচাপযুক্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক উভয় রক্তচাপকেই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করণে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে জবা ফুলের চা।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
রক্তচাপ কমানোর পাশাপাশি জবা ফুলের চা রক্তে চর্বির মাত্রাও কমাতে সাহায্য করে। রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া হৃদরোগের দিকে ঠেলে দেয়। যাদের কোলেস্টেরল মাত্রা বেশ খারাপ পর্যায়ের, এই চা পান এক মাসের মধ্যে তাদের কোলেস্টেরলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। কোন রকম শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া ব্যক্তিরাও তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রায় ভারসাম্য বজায় রাখতে এই চা পান করতে পারেন। জবা ফুলের নির্যাস ভাল কোলেস্টেরল বা হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন বাড়িয়ে দেয় এবং খারাপ কোলেস্টেরল বা লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: ওজন কমাতে ১০ কার্যকরী পানীয়
ওজন কমানো
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে ঘনীভূত জবা ফুলের বৃন্তের যুগান্তকারি প্রভাব রয়েছে। এর চা-এর ফলে বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই), শরীরের ওজন, শরীরের চর্বি এবং নিতম্ব থেকে কোমরের অনুপাত কমে যায়। এটি বিশেষ করে স্থূলকায় ব্যক্তিদের জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দিয়ে প্যাক করা
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এমন একটি অণু, যা কোষের ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক যৌগের সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে। এই উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে পাতা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। আর তাই এটি ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে মুক্ত করতে এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
লিভারের স্বাস্থ্য রক্ষা
প্রোটিন উৎপাদন থেকে শুরু করে চর্বি ভাঙ্গা সহ শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের জন্য লিভারের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো থাকা অপরিহার্য। জবা ফুলের চা পানে লিভার ক্রমাগত ভালোভাবে কাজ করে যেতে পারে। অতিরিক্ত ওজনের মানুষের ক্ষেত্রে তিন মাস জবা ফুলের নির্যাস লিভার স্টেটোসিস উন্নত করে দিতে পারে। এতে করে লিভার এতে জমে থাকা চর্বি থেকে মুক্তি পায়।
আরও পড়ুন: জেনে নিন ডালিমের খোসার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার
হজমে সহায়তা
মূত্রবর্ধন প্রয়োজনীয় পানি ও লবণকে দেহে রাখতে সহায়তা করে যেগুলো প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। এই চা প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও এটি মূলত চিনি ও ক্যাফেইন-মুক্ত পানীয় পান করার একটি ভালো মাধ্যম, যেটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সহায়তা করে। ফলশ্রুতিতে, শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির উপস্থিতি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে হজমে সহায়তা করে।
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা
ব্যাকটেরিয়া হল এককোষী অণুজীব, যা ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ও মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রভৃতি রোগের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিক্যান্সার বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে জবা ফুল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারে।
ই.কোলি নামের ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্র্যাম্পিং, গ্যাসট্রিক এবং ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে থাকে। জবা ফুলের নির্যাস এই ব্যাকটেরিয়াটির কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া আরো বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এই নির্যাস বেশ কর্মক্ষম। এমনকি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসায় রীতিমত অ্যান্টিবায়োটিকের মতই কাজ করে।
আরও পড়ুন: গোল্ডেন মিল্কের জাদুকরি উপকারিতা
জবা ফুলের চা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
রক্তচাপ অতিরিক্ত কমে যাওয়া
কম রক্তচাপ সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এই চা পান বিপজ্জনক হতে পারে। এই পানীয় দেহে রক্তচাপের ভারসাম্যতা যাচাই না করেই রক্তচাপ কমাতে থাকে। তাই চরম অবস্থায় নিচু রক্তচাপের আনুষঙ্গিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যারা ইতিমধ্যেই রক্তচাপ কমানোর জন্য ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের জন্যও এই চা পান এড়িয়ে চলা উচিত।
রক্তচাপ অনেক কমে গেলে হ্যালুসিনেশন পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি এমনকি যারা উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও এই চা পানের সময় তাদের রক্তে শর্করা এবং রক্তচাপের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। নতুবা অবস্থা আরো খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে।
ব্লাড সুগার মাত্রাতিরিক্ত কমে যাওয়া
নিম্ন রক্তচাপের মতো রক্তে শর্করার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হ্রাস পাওয়াও অনেক ঝুঁকি নিয়ে আসে। যাদের রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওষুধ চলছে, তাদের এই চা না পান করাই ভালো। এছাড়া যাদের মাঝারি থেকে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাদেরও এই পানীয়টি এড়িয়ে চলা উচিত। স্পষ্টতই সেই পরিস্থিতিতে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ আরো কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।
আরও পড়ুন: অপরাজিতা ফুলের নীল চা: জাদুকরী স্বাস্থ্যগুণ, বানানোর পদ্ধতি
শরীরে ওষুধের কার্যকারিতা লোপ পাওয়া
জবা ফুলের চা একটি ভেষজ পানীয় হওয়ায় ওষুধের সাথে এর সাধারণ যোগসাজস আছে। তাই সে অনুযায়ী আনুষঙ্গিক ঝুঁকিও নিয়ে আসে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটি হলো টাইলেনলের সক্রিয় উপাদান অ্যাসিটামিনোফেন। শরীরের অভ্যন্তরে জবা ফুলের চা ও এই উপাদানের সংমিশ্রণ লিভারের জন্য চরম ক্ষতিকর হতে পারে। ফলশ্রুতিতে মূত্রবর্ধক সহ নানা ধরনে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে বাঁচার নিমিত্তে এদের পরস্পরের সাথে মিশ্রিত করা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
যারা ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন গ্রহণ করেন তাদের জন্য এই শক্তি বর্ধক পানীয় সেবন নিরাপদ নয়। শরীরে এর উপস্থিতি ও প্রভাব স্থায়ী করার জন্য অন্য ওষুধের কার্যকারিতাকে নিমেষেই নষ্ট করে দেয়।
জবা ফুলের চা বানানোর পদ্ধতি
টক স্বাদযুক্ত হলেও জবা ফুলের চা কে সুস্বাদু পানীয়তে পরিণত করা যায় এবং এই চা বানানোর যাবতীয় প্রস্তুতি বাড়িতেই নেয়া সহজ। চায়ের জন্য নির্ধারিত মগটিতে ভালো ভাবে পিষে নেয়া জবা ফুলের কিছু বৃন্ত রাখতে হবে। অতঃপর তাতে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিতে হবে। এই সহজ মিশ্রণটি পাঁচ মিনিটের জন্য রেখে দেয়ার পর ছেঁকে নিলেই একদম সাধারণ মানের জবা ফুলের চা তৈরি হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: কঠোর ডায়েটের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহ জেনে নিন
তবে ফুলের টক স্বাদে পরিবর্তন আনতে গরম পানি যুক্ত করার আগে অথবা পরে প্রয়োজন মত মধু ও লেবুর রস দেয়া যেতে পারে। এতে টক স্বাধের ভারসাম্য বজায় থাকবে আবার স্বাদ মিষ্টিও হয়ে যাবে। এছাড়াও সাধারণ রঙ চায়ের মত ছোট ছোট আদার টুকরাও যোগ করা যেতে পারে।
এটি ঠান্ডা-গরম উভয় অবস্থাতেই পান করা যায়। তৈরি চা ঠান্ডা হলে ফ্রিজে দুই দিন রেখে দিলেই দারুণ একটি আইস টি হয়ে যায়। তাছাড়া সদ্য বানানো চা ঠান্ডা করার পর কিছু বরফ কুঁচি যোগ করেও ঠান্ডা চায়ের ফ্লেভার নেয়া যায়।
জবা ফুলের চা দোকানে রেডিমেড টি-ব্যাগেও পাওয়া যায়। সেগুলো সহজভাবে গরম পানিতে প্রয়োজন মত ভিজিয়ে উঠিয়ে নিলে কম সময়েই পানের উপযোগী হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: লাল চাল: কেন খাবেন এবং কারা এড়িয়ে চলবেন?
শেষাংশ
ভেষজ পানীয় জবা ফুলের চায়ের স্বাস্থ্যগুণ নিয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো উতড়ে সম্পূর্ণ উপযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে এই চা পানকারির উপর এর প্রতিটি প্রভাব সুক্ষ ভাবে যাচাই করা হচ্ছে। অবশ্য নিত্য দিনের খাদ্যাভাসে ২ থেকে ৩ কাপ জবা ফুলের চা রাখা যেতে পারে। এর বেশি পান করাটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পান করা হলে খাদ্যাভাসে স্বাদ পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য সম্মত উপকারিতায় এই চা একটি দারুণ সংযোজন হতে পারে।
২ বছর আগে