নরওয়েতে বিনামূল্যে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের উপায়
নরওয়েতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের উপায়
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, পড়শোনার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ এবং ক্যারিয়ারের সুব্যবস্থা থাকার কারণে বিদেশে পড়তে চাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রিয় পছন্দ নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে। স্কলারশিপের কোটা প্রকল্প বর্তমানে না থাকলেও, বিদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে স্নাতকোত্তরের সুবিধা রেখেছে নরওয়েজিয়ান সরকার। অন্যান্য বহিরাগতদের ন্যায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও নিজেদের যোগ্যতায় অধ্যয়ন করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) এই সদস্য দেশটির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শুধুমাত্র নামমাত্র রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে নিজেদের পছন্দমত ইংরেজি ভাষার মাস্টার্স কোর্সগুলো করতে পারছে। এবার নরওয়েতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর করার জন্য আবেদনের প্রতিটি পর্যায় জেনে নেয়া যাক।
নরওয়েতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর করার জন্য পর্যায়ক্রমিক আবেদন পদ্ধতি
প্রথম ধাপ: সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও পরিকল্পনা
যে কোনো কাজের জন্যই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়টি হচ্ছে পূর্বপ্রস্তুতি, যাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে সেই বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানার্জন বা তথ্য সংগ্রহ। সেখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি দেশে যখন পড়তে যাওয়া হচ্ছে, তখন অভিবাসনের যাবতীয় খুঁটিনাটি ভালো করে জেনে নেয়া আবশ্যক।
সবার প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে সেই দেশটিতে যাওয়ার পেছনে শিক্ষার্থীর আসল উদ্দেশ্য সম্পাদনের ব্যাপারে। তাই এই পর্যায়ে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে মাস্টার্স করতে ইচ্ছুক সে বিষয়টি সেই দেশের নামকড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অফার করছে কিনা তা ভালোভাবে জানতে হবে। নরওয়ের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে চাহিদাপূর্ণ বিষয়গুলোতে দুই বছর মেয়াদী মাস্টার্স করার সুযোগ আছে। এর জন্য নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় দেশের বাইরে যেতে প্রস্তুতির ধাপগুলো জেনে নিন
আরও যে বিষয়টি এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে- এই পুরো পদ্ধতিটিতে কত টাকা খরচ হবে তা সুষ্পষ্টভাবে জেনে এখন থেকেই তা যোগাড়ের ব্যবস্থা শুরু করা। গুটি কয়েক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাদে নরওয়ের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা একদম ফ্রি। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে যে রেজিস্ট্রেশন ফিটা দেয়া লাগে তা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে তিন থেকে সাত হাজারের মত।
তবে সমস্যা হলো- অন্যান্য দেশগুলোর মত এখানে শুধু ব্যাংক সল্ভেন্সি দেখালেই হয় না। ভিসা হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাবার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়র একাউন্টে প্রায় ১২ লাখ টাকা পাঠাতে হয়। নরওয়েতে এক বছরের শিক্ষার্থীর থাকার খরচ বাবদ অগ্রিম এই টাকাটা নেয়া হয়। এটা আসলে কোনো ব্যাংক সলভেন্সি দেখানো না বা কোনো ব্লক্ড একাউন্ট না।
জার্মানির ক্ষেত্রে যেটা হয়- বিশ্ববিদ্যালয়র একাউন্টে টাকা পাঠানোর পর সেই টাকা ১২ মাসে ভেঙে ভেঙে ফেরত দেয়া হয়। আর নরওয়েজিয়ান ইউনির্ভাসিটিগুলো টাকাটা একবারেই দিয়ে দেয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নরওয়েতে যাওয়ার পর নিজের একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সেই ১২ লাখ টাকা শিক্ষার্থীর ব্যাংক একাউন্টে ফেরত দিয়ে দেয়। এই বিষয়গুলো পরিকল্পনার সময় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার আগে যে অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা জরুরি
দ্বিতীয় ধাপ: আইইএলটিএস দেয়া
নরওয়েতে আন্ডারগ্রাজুয়েশন করার জন্য সাধারণত স্টুডেন্ট ভিসা দেয়া হয় না। এর পেছনে কারণ হলো ওদের অধিকাংশ আন্ডারগ্রাজুয়েশন কোর্স নরওয়েজিয়ান ভাষায় পড়ানো হয়। তবে স্নাতকোত্তর সব কোর্সই ইংরেজি ভাষায় করার সুযোগ রয়েছে। এই ক্ষেত্রে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইংরেজি হওয়াতে আইইএলটিএস ছাড়া নরওয়েতে পড়তে যাওয়া সম্ভব নয়। নূন্যতম স্কোর ছয় পয়েন্ট পাঁচ হতে হয় তবে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছয় স্কোরও গ্রহণ করে। সুতরাং পরিকল্পনার পর নরওয়েতে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতির জন্য করণীয় হিসেবে প্রথম কাজ হলো আইইএলটিএস দেয়া।
নরওয়েতে পরিবার নিয়েও আসা যায়। আবেদনকারী যদি স্বামী হন তাহলে তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য আইইএলটিএস প্রয়োজন নেই। আবার স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী ও সন্তানের আইইএলটিএস স্কোর লাগবে না। তারা শুধুমাত্র অতিথি হিসেবে আবেদনকারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে নরওয়ে আসতে পারবেন।
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
তৃতীয় ধাপ: আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যোগাড়
→ এসএসসি, এইচএসসির ও নূন্যতম তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রির সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট
(জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও আবেদন করতে পারবেন। স্টাডি গ্যাপ সর্বোচ্চ চার বছর গ্রহণযোগ্য)
→ পাসপোর্ট
→ আইইএলটিএস সনদ
→ স্টাডি প্ল্যানসহ মোটিভেশন লেটার
→ দুটি রিকমেন্ডেশন লেটার (যে বিষয়ে নরওয়েতে পড়তে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ের ওপর অধ্যাপকের কাছ থেকে একটি, আর আরেকটি ব্যাচেলর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের ডিনের কাছ থেকে)
→ ব্যাংক সলভেন্সি পেপার
এগুলো ছাড়াও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আরও কিছু নথি চাইতে পারে। এর জন্য সর্বোত্তম কাজ হলো- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট ভালোভাবে অধ্যয়ন করে নেয়া।
আরও পড়ুন: সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
চতুর্থ ধাপ: আবেদন
প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যোগাড় হয়ে গেলে এবার চূড়ান্ত আবেদনের পালা। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা স্টাডি ইন নরওয়ে ওয়েবসাইটে যেয়ে খুব সহজেই আবেদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারবেন। এই সাইটের মাধ্যমে আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়তে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর আবেদনের ব্যবস্থা রয়েছে। নিজের কাঙ্ক্ষিত বিষয়টির পাশে দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়র নামের ওপর ক্লিক করে বিশ্ববিদ্যালয়তে আবেদনের পেইজে প্রবেশ করা যাবে।
অতঃপর এই অনলাইন আবেদনে যা যা নথি চাওয়া হবে সেগুলো সব আপলোড করে সংযুক্তি হিসেবে দিতে হবে। তাই আগে থেকেই কাগজপত্রগুলোর স্ক্যান কপি প্রস্তুত করে রাখতে হবে। আর এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াতে কোথাও কোনো ধরনের ফি প্রয়োজন হবে না।
এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে আবেদনের জন্য দরকারি কাগজপত্র সংগ্রহ করা এবং চূড়ান্ত আবেদনের ক্ষেত্রে সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে। নরওয়েতে স্নাতকোত্তরে ভর্তির জন্য মূলত একটাই সেশন। প্রতি বছরের আগস্টে সেশন শুরু হয়। আর এই সেশন ধরার জন্য আবেদন করতে হয় ঠিক তার এক বছর আগে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। তার মানে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের সেশন ধরতে হলে আবেদনের সময় শুরু হবে ২০২২ এর আগস্ট থেকে।
আরও পড়ুন: জার্মানিতে স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামে আবেদন করে দরকারি সব কাগজপত্রের সফট কপি জমা দিয়ে ফেলতে হবে। আবেদনের পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবেদনকারীকে একটা কনফারমেশন মেইল দেয়া হবে। এ সময় অতিরিক্ত কোনো কাগজ লাগলে সেটা মেইল করে জানানো হবে।
পঞ্চম ধাপ: ভিসার জন্য আবেদন
আবেদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর ফলাফল আসবে পরের বছরের মার্চের শেষ নাগাদ কিংবা এপ্রিলের শুরুর দিকে। ঠিক এই সময়েই ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। অফার লেটার পাওয়ার পর আবেদনের সময় জমা দেয়া কাগজপত্রগুলো এবার অ্যাটাস্টেড করে গুলশানের ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিস) গ্লোবালে যেয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়র দেয়া একাউন্টে ১২ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে। এই টাকা পাঠানোর কনফারমেশন পেপারও সেই ভিএফএস গ্লোবালে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়।
এখানে দরকারি কাগজপত্রগুলোর সঙ্গে পূর্ণ পূরনকৃত ভিসা আবেদন ফর্ম, শেঞ্জেন ফরমেটের (৩৫ মিলিমিটার বাই ৪৫ মিলিমিটার) ছবি, স্টেটমেন্ট অব পার্পাস, কভার লেটার, অ্যাম্বেসির মনোনীত প্রতিষ্ঠান থেকে হেলথ ইনসুরেন্স সনদ এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ভিসার যাবতীয় প্রক্রিয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৬২ হাজার টাকার মত খরচ হবে। সবকিছু পাওয়ার পর ভিএফএসের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ নেয়া হবে। ইন্টারভিউয়ের ১২ থেকে ১৪ কার্যদিবস পর কাঙ্ক্ষিত সেই নরওয়ে যাবার ভিসা হাতে পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: জাপানকে উচ্চশিক্ষার জেডিএস বৃত্তির পরিধি ও সংখ্যা বৃদ্ধির অনুরোধ
নরওয়ের নাগরিকত্ব নিয়ে কিছু কথা
নরওয়ের পিআর (পার্মানেন্ট রেসিডেন্স) ব্যবস্থা বেশ সহজ। দুবছর অধ্যয়নের পর যে বিষয়ে মাস্টার্স করা হয়েছে সে বিষয়ের ওপর কোনো চাকরি যোগাড় করতে পারলেই পিআর নিশ্চিত। তিন বছর মেয়াদী পিএইচডি করা অবস্থাতেও এই পিআর পাওয়া যায়। কারণ নরওয়েতে পিএইচডি কে চাকরি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তার মানে পিআর-এ কোনো অনিশ্চয়তা নেই।
শেষাংশ
সবশেষে বলা যায় যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য নরওয়েতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছে। শুধু একটি সম্মানজনক ক্যারিয়ারই নয়; উচ্চশিক্ষার এই সুযোগটি কাঙ্ক্ষিত ও উন্নত জীবন ধারণের একটি কারুকার্যমণ্ডিত সোপান। নিজেদের জীবনকে সুন্দর করার পাশাপাশি এই তরুণরা বাংলাদেশের জন্য বিপুল সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধশালী জীবনের লক্ষ্যে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও রেখে যাচ্ছে অনুসরণীয় পদচিহ্ন।
২ বছর আগে