অর্থ বিনিয়োগ
অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যম: বৈধভাবে টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবেন?
জীবনে স্বচ্ছলতা আনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ একটি জরুরি বিষয়। মধ্যম আয় থেকে শুরু করে উচ্চ আয়ের কর্মজীবীরা বৈধভাবে টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবেন তা নিয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকেন। দেখা গেছে যে বেশিরভাগ বাংলাদেশিই তাদের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকে জমা রাখেন। নির্দিষ্ট সুদের হারের সঙ্গে বিনিয়োগের স্কিমগুলো দিন দিন বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তবে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ ভবিষ্যতে আর্থিক সুরক্ষায় সম্পদ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। সদূরপ্রসারী বিনিয়োগের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এতোটাই লাভজনক যে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে। গড়পড়তায় যে কোনো আয়ের লোকদের জন্য ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করাটা নিরাপদ। আসুন জেনে নেয়া যাক বৈধভাবে অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করলে লাভবান হতে পারেন।
অর্থ বিনিয়োগের সেরা কয়েকটি মাধ্যম
ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি)
ব্যাংকিংয়ের এই মাধ্যমের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম খেয়াল রাখতে হয় দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ জমা রাখার ব্যাপারে। কম বেশি যে রকমেরই সুদের হার হোক না কেন, উপার্জনের বড় সংখ্যক অর্থটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকবে লম্বা সময় ধরে। মূলত এই ধরনের অ্যাকাউন্টে অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি সাধারণ সঞ্চয় ভিত্তিক অ্যাকাউন্ট থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ পেয়ে থাকেন।
শুধু ব্যাংকিই নয়; যেকোনো ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও ফিক্সড ডিপোজিটের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সুদের হার কম বেশি হয়ে থাকে। নিশ্চিত রিটার্নস পাওয়ার জন্য ফিক্সড ডিপোজিট বিনিয়োগের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। এখানে সুদের পরিমাণ মার্কেটে সুদের হারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটি যে হারে সুদ নির্ধারণ করেছিল সেই হারেই বিনিয়োগকারি রিটার্নস পেয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন: ধনী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রিমিয়াম ভিসা চালু করছে মালয়েশিয়া
যেকোনো সময় ডিপোজিটের মেয়াদ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় পরিবর্তন করা যায়। সুদের হার পে-আউট, মাসিক ও ত্রৈমাসিক হিসেবে নির্বাচন করা যায়। পুনঃবিনিয়োগের ব্যবস্থা তো থাকছেই, সেই সঙ্গে আছে পাঁচ বছর মেয়াদের এফডির জন্য কর মুক্তির সুবিধা।
সঞ্চয়পত্র
বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ঝুঁকিমুক্তভাবে জনগণের বিনিয়োগের পথ তৈরি করে সঞ্চয়পত্র। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় স্কিমে জনগণকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ নেয়া হয়ে থাকে। স্থানীয় ও প্রবাসী; এই দুই ধরনের বাংলাদেশিদের জন্য আলাদা আলাদা সঞ্চয়পত্র গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদের এই সঞ্চয়পত্রগুলো অর্থ বিনিয়োগের বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা দিয়ে থাকে। সেই সূত্রে, এটি নিঃসন্দেহে বৈধভাবে টাকা বিনিয়োগের একটি উপযুক্ত মাধ্যম।
বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি করা সঞ্চয়পত্রে ভিন্ন মেয়াদের সুদের হার পরিচালনা করে। ১৮ বছরের ওপরে যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক সঞ্চয়পত্র কেনার যোগ্যতা সম্পন্ন। এই মাধ্যমে একক বা যৌথভাবেও অর্থ বিনিয়োগ করা যায়। সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত একজন ব্যক্তি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে। মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে এতে লাভ থাকে কমপক্ষে ৯ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
শেয়ার বাজার
বিনিয়োগকারিদের জন্য রীতিমত স্বর্গ বলা যেতে পারে শেয়ার বাজারকে। এখানে কেবল অর্থই না; সেই সঙ্গে দরকার হয় নানা ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য, শিক্ষা, বুদ্ধি ও সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গি।
এই দক্ষতা কারণেই প্রায়ই সময় দেখা যায় যে একদিকে কেউ শেয়ার বাজারে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর অন্যদিকে কেউ নিজের সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে। তাই বলে শেয়ার বাজার কিন্তু কোনো জুয়া নয়। এখানে যে ব্যাপারটি দিন শেষে ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়, সেটি হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণের জ্ঞান ও মেধা। উপযুক্ত শেয়ার সঠিক সময়ে যারা ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারছে তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটি বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে। আর এক্ষেত্রে অপারগরাই দিন শেষে ক্ষতির সম্মুখীন হন।
শেয়ার বাজারে সাফল্য লাভের নিদিষ্ট কোনো ফর্মুলা নেই, তবে তুখোড় ব্যক্তিরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারেন যে কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনা ঠিক আর কোনটা ভুল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে বৈধভাবে রেমিটেন্স পাঠানোর সেরা কয়েকটি মাধ্যম: বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবেন যেভাবে
মিউচুয়াল ফান্ড
বিনিয়োগ থেকে উচ্চ হারে রিটার্নপ্রাপ্তি মানেই মিউচুয়াল ফান্ড। বিনিয়োগকারীর টাকাটা এখানে বিনিয়োগ হয় ঋণ তহবিলে। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা উচিত দীর্ঘমেয়াদে, তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাজারের ওঠানামা। তাই স্বাভাবিকভাবেই বড় পরিমাণে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ডেট ফান্ডের ক্ষেত্রে এই ঝামেলা কম।
অনেকেই ভাবেন মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের প্রথম শর্ত ভারতীয় হওয়া। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, শুধু বাংলাদেশই নয়; বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে নির্দিষ্ট ব্যাংক শাখা কিংবা বুকারের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এই ফান্ডে বিনিয়োগ করা যায়। বর্তমানে এর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এটাই বোঝায় যে, মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করার মাধ্যমে আসলেই ভালো পরিমাণ লাভের মুখ দেখা যায়। বাংলাদেশে অনেক ব্যাংকের মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডে গ্রাহকরা বিনিয়োগ করে থাকে।
গোল্ড বা স্বর্ণ
বর্তমানে মুদ্রাস্ফিতির এক বিভীষিকাময় অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ববাসী। আজকের ১০০ টাকায় যা ক্রয় করা সম্ভব, আগামী ১০ বছর পরের ১০০ টাকায় তা কল্পনাও করা যাবে না। আর অর্থের এই সময় মূল্যের যখন ভয়াবহ হারে অধঃগমন ঘটে তখনি অর্থনীতির খারাপ সময় শুরু হয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বিনিয়োগে আগ্রহী সুইজারল্যান্ড
এটা খুবই স্বাভাবিক যে মূল্য কমে যাওয়া থেকে টাকাকে বাঁচাতে হলে কোনো না কোনো খাতে অবশ্যই বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুঃসাহসের চর্চায় যারা ভয় করেন তাদের একমাত্র গন্তব্য স্বর্ণ মজুদ। স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলে; বিশেষত দীর্ঘ মেয়াদে মূল্য অনেক বেশি বেড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। স্বর্ণ ক্রয় করে মজুদ রাখাটা অর্থ বিনিয়োগের বৈধ একটি উপায়।
এখন ডিজিটাল গোল্ড ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে খুব সহজেই যেকোনো অর্থের ওপর কিংবা যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বর্ণ বিনিয়োগ করা যায়। এই ইনভেস্টমেন্ট হলো প্রকৃত স্বর্ণ না কিনেও তার মালিক হওয়া, যা সেই মালিকের নামে মজুদ থাকবে নিদিষ্ট একটি কোম্পানির ভল্টে।
রিয়েল এস্টেট
টাকা বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। রিয়েল এস্টেট হলো আবাসিক ও অনাবাসিক প্লট বা বাড়ি ক্রয় ও বিক্রয়, ডেভেলপমেন্ট, ব্যবস্থাপনা, ভাড়া দেয়া বা নেয়া ইত্যাদি। আবাসন একজন নাগরিকের মৌলিক চাহিদা। স্বভাবতই বসবাস ভিত্তিক আবাসিক স্থানের চাহিদা যতই দিন যাচ্ছে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে জায়গা বা বাড়িগুলোর দাম।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আবুধাবির বিনিয়োগকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
তাছাড়া এই লেনদেনে অর্থের পরিমাণ থাকে প্রচুর। একদিকে যেমন খরচ হয় আরেক দিকে পাল্লা দিয়ে উপার্জনও হয় অত্যাধিক। তাই রিটার্নের কথা ভাবলে রিয়েল এস্টেটের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় ব্যবসার তালিকায় থাকবে। এমনকি যখন দেশের মুদ্রাস্ফিতির প্রভাব পরে, তখনও এই ব্যবসার বাজার ভালো থাকে। সঠিন জ্ঞান ও মূলধনের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ব্যবসায় বিনিয়োগ হতে পারে দীর্ঘ মেয়াদি আয়ের উৎস।
বীমা
বীমা মানেই কিন্তু শুধুমাত্র ঝুঁকি কমানোর কোন স্কিম নয়। ঝুঁকির হ্রাস পাওয়া একটা সুবিধা; আর এর সঙ্গে সঙ্গে মেয়াদান্তে যথেষ্ট পরিমাণে মুনাফাও লাভ করা যায়। বাংলাদেশে অনেকগুলো বীমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লাভ সরবরাহ করে আসছে।
এই খাতটিও বিনিয়োগের একটি ভালো পছন্দ হতে পারে। তবে অবশ্যই এর আগে ভালো করে যাচাই করে নিতে হবে। শুধুমাত্র এই একটি খাতকে কেন্দ্র করে সমুদয় বিনিয়োগ ঢেলে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। একজন সুবিবেচক ততটুকুই ঝুঁকি নেন, যতটুকু তিনি পুষিয়ে নিতে সক্ষম থাকেন।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বহুমুখী বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ
পরিশেষে
সবশেষে বলা যেতে পারে যে চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আয় বাড়ানোর সেরা উপায় অর্থ বিনিয়োগ। কর্মজীবনের প্রথম দিক থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু করলে বৈধভাবে টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবেন তা নিয়ে যাবতীয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে কেটে যায়। ফলশ্রুতিতে অবসর গ্রহণের বেশ আগেই হাতে মোটা অঙ্কের টাকা চলে আসে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা একজন বিনিয়োগকারিকে অর্থায়নের নানা খাত সম্বন্ধে জ্ঞানী করে তোলে। তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হলেও বিনিয়োগ করাতে অভ্যস্ত হতে হবে। নতুবা অভাবের নিষ্পেষনে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে দাঁড়াবে। বিনিয়োগ কিন্তু যে কোনো বয়স থেকেই শুরু করা যায়। শুধু প্রয়োজন বাজেট অনুযায়ী পরিকল্পনা করে সেরা বিকল্পটা বেছে নেয়া।
২ বছর আগে