বিপন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন: খুলনায় চিংড়ি চাষ বিপন্ন
খুলনার চাষি ও রপ্তানিকারকরা চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ায় চিন্তিত। কারণ, এ অঞ্চল থেকে রপ্তানিতেও প্রভাব পড়েছে। প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তনে এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে খুলনা থেকে মাত্র ৩৩ হাজার ২৭১ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের ৪২ হাজার ৪৮৯ টন রপ্তানির হিসাবে যা বেশ কম।
শিল্প পরিচালকরা বলছেন যে জলাশয়গুলো তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে প্রাকৃতিক ভরা জোয়ারের দুর্বল শক্তির কারণে লবণাক্ততার স্তর ওঠানামা করছে। যা এই অঞ্চলে চিংড়ি চাষকে প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবীর ইউএনবিকে বলেন, ‘৬০’র দশকে দেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি শিল্প হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘গুণগত মানের কারণে ৮০’র দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। সেই সঙ্গে চাহিদা ও দামও কমেছে।’
হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যুহার বেড়েছে।’
আরও পড়ুন: খুলনায় জেল-ইনজেক্টেড চিংড়ি জব্দ, আটক ১৮
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক চিংড়ির পোনাও মিলছে না। অল্প কিছু পাওয়া গেলেও ঘেরে ছাড়ার পর পানির তাপমাত্রা সহনীয় না থাকায় সেগুলো টিকছে না। ফুটন্ত পানিতে চিংড়ি কতক্ষণ টিকতে পারে? তাপমাত্রা সহনীয় থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা এখন নেই।’
ভালো পরিবেশ না থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিংড়ির পোনা খুবই স্পর্শকাতর। এর জন্য পানি, খাবার, পরিবেশ ও তাপমাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি তাপমাত্রা সহনীয় না থাকা ও রোগবালাই শেষ না হওয়াকে ইঙ্গিত করেন।
খুলনা বিভাগীয় পোনা মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, ‘জানুয়ারি মাস থেকে এই অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি চলে আসে। গত বছর লবণাক্ত পানি আসতে দেরি হয়। ফলে এক মাস পিছিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ত পানি আসে। এ বছরও তাই হয়েছে। বৃষ্টির সময় বৃষ্টি নেই। পানিতে লবণের পরিমাণ অসময়ে বেশি হচ্ছে, আবার প্রয়োজনের সময় কমে যাচ্ছে।’
চিংড়ির চাষ ব্যাহত হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাধারণত মে-জুন মাসে পানিতে লবণের মাত্রা ১৬-১৮ পিপিটি থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ৮-১০ পিপিটিতে নেমে আসে। বৃষ্টির স্বাভাবিক গতি ঠিক না থাকায় লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
কিবরিয়া জানান, ‘আগে সনাতন পদ্ধতির ঘেরে হ্যাচারির পোনা ছাড়ার পর ৬০-৭০ শতাংশ টিকতো। এখন ১৫-২০ শতাংশ পোনাও বাঁচে না। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া ও লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে চিংড়ি চাষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের। এ অবস্থায় কেউ কেউ চিংড়ি ছেড়ে সাদা মাছ চাষ করছেন।’
আরও পড়ুন: কলাপাতায় চিংড়ি ভাপা
নদ-নদীর নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিং করা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নদ-নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। জোয়ারের পানি ঘেরে ঢোকানোর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা আসতো। কিন্তু নাব্যতা সংকটের কারণে এখন ওসব পোনা আসে না। পানির এ অবস্থার কারণে মাটির তারতম্যে পরিবর্তন হয়েছে হয়তো। যে কারণে চিংড়ি চাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ৩০-৪০ বছর ধরে আমরা যারা চিংড়ি চাষ করছি, তারাও লোকসানে পড়েছি।’
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার বলেন, ‘পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে নজরদারি বাড়ানোসহ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
চাষি থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার কথা জানান জয়দেব কুমার।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোস্তফা সারোয়ার বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চিংড়ির রেণুর মৃত্যুরহার বেড়েছে। প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কৃত্রিম খাবার দেয়া লাগছে। এতে অল্প কিছু রেণু টিকছে। বাকিগুলো মারা যাচ্ছে।’
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে রেণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি না হওয়ার কথা বলেন মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘রেণুর তাপ সহ্য ক্ষমতা আর বয়স্ক চিংড়ির তাপ সহ্য ক্ষমতার পার্থক্য আছে। সাধারণত ঘের তৈরির পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে রেণু ছাড়া হয়। মার্চে এসে মারাত্মক গরম পড়ে। তখন তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি হলে তো পানির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি থাকে না। সেটি ২৭ ডিগ্রিতে উঠে যায়। যা রেণুর জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে না।’
আরও পড়ুন: শাবিপ্রবির গবেষণা: হাওরের ইকোসিস্টেম সার্ভিসে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণ
তিনি আরও বলেন, গরম পানিতে রেণু টিকতে পারছে কম। আর ঘেরের গভীরতা কম, ঘেরে পানির উচ্চতাও বাড়ে না। বায়ুর তাপে পানি গরম হয়ে ওঠে। যা চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাপমাত্রা বাড়লে যেকোনো ধরনের ভাইরাসের দাপট বেড়ে যায়। ভাইরাসের জীবনচক্র সক্রিয় অবস্থানে রাখতে প্রয়োজন তাপমাত্রা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করে মোস্তফা বলেন, ‘এতে গরমের কারণে চিংড়ির পোনার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় যদি ভাইরাস পানির সংস্পর্শে চলে আসে সেটা ভাইরাসের জন্য সহনীয় অবস্থান। ফলে বড় চিংড়িতে ভাইরাস আক্রান্তে সময় লাগলেও ছোট চিংড়ি আক্রান্ত হতে সময় লাগে না। এজন্য রেণু দ্রুত মারা যায়। চিংড়িতে মড়ক দেখা দেয়।’
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন বৈশ্বিক উদ্যোগ চায় ঢাকা
পদ্মায় ২৪ কেজির বিপন্ন প্রজাতির বাগাড় ২৭ হাজারে বিক্রি
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় এলাকায় পদ্মা নদীতে ২৪ কেজি ওজনের একটি বিপন্ন প্রজাতির বাগাড় মাছ ধরা পড়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে ওই বাগাড় মাছটি স্থানীয় জেলে হজরত মন্ডল ও কাদের মন্ডলের জালে ধরা পড়ে। পরে বাগাড়টি স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী সোহেল মোল্লা ২৭ হাজার ৬০০ টাকায় কিনে নেন।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানান, শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে বাহির চর দৌলতদিয়া ছাত্তার মেম্বার পাড়ার জেলে হজরত মন্ডল ও কাদের মন্ডল মাছ শিকারে নামেন। জাল ফেলে প্রায় তিন কিলোমিটার ভাটিতে যাওয়া মাত্র টান আঁচ করতে পারে। তখনই জাল গুটিয়ে নৌকায় তুলতেই দেখতে পান বড় এক বাগাড় ধরা পড়েছে। জাল গুটিয়ে জেলেরা চলে আসেন দৌলতদিয়ার ছয় নম্বর ফেরি ঘাটে। এ সময় একতা মৎস্য আড়তের সত্ত্বাধিকারী দুলাল মন্ডল ২৪ কেজি ওজনের বাগাড়টি নিলামে তুলেন। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ফেরি ঘাট এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মো. সোহেল মোল্লা ১ হাজার ১৫০ টাকা কেজি দরে কিনেন।
আরও পড়ুন:দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ৩১তম
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার পদ্মা নদীতে ২৫ কেজি ওজনের আরেকটি বাগাড় মাছ ধরা পড়ে।
বাগাড় একটি বিপন্ন প্রজাতির মাছ। এ ধরনের মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হলেও গোয়ালন্দের পদ্মা নদীতে মাঝে মধ্যেই জেলেদের জালে ধরা পড়ছে এই বিপন্ন প্রজাতির মাছ। আবার এই বাগাড় মাছ দৌলতদিয়া ঘাটেই প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে হাঁকডাক ছেড়ে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা এ ধরনের মাছ ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, আমলা বা সরকারি চাকরীজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিক্রি করে থাকেন।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিলে বাগাড় মাছকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বন্য প্রাণী (সংলক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ সালের জানুযারি বিপন্ন প্রাণী ধরা বা কেনাবেচা দণ্ডণীয় অপরাধ বলে আইন করেছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের লাল তালিকায়ও রয়েছে বাগাড় মাছের নাম।
গোয়ালন্দ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা শাহ মো. শাহারিয়ার জামান সাবু বলেন, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছোট বাগাড় মাছ ধরা যাবে না। তবে বড় বাগাড় মাছ ধরা বা খাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোন সমস্যা নেই। বাগাড়কে বিপন্ন মাছ হিসেবে চিহিৃত করে তা ধরতে কোন নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত তাদের কাছে আসেনি বলে তিনি দাবি করেন।
আরও পড়ুন:বাগেরহাটে আড়াই ঘণ্টায় ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, পানিতে নিমজ্জিত ফসল
২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা