নিরাপদ ভ্রমণ
বর্ষাকালে সুউচ্চ ঝর্ণা-পাহাড়ে হাইকিং ও ট্রেকিং: ঝুঁকির কারণ ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা
দেশের সুউচ্চ দুর্গম পাহাড়গুলো প্রতিনিয়ত এক অমোঘ আকর্ষণে কাছে টানে দুঃসাহসিক ভ্রমণপিপাসুদের। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঝর্ণার পানিতে স্নান করার অভিজ্ঞতা নিতে মুখিয়ে থাকে হাইকার ও ট্রেকাররা। কিন্তু এই শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের প্রতি পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু ফাঁদ।
চলতি বছর ২১ জুন বান্দরবানের আলীকদমের মারাইংতাং পাহাড়ে খিঁচুনির পর রহস্যজনকভাবে মারা যান মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইফতেখারুল আহমেদ আবিদ (২০)। গত বছর ১২ আগস্ট এই একই অঞ্চলের সাইংপ্রা পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে মারা যান ২৯ বছর বয়সি ট্যুর গাইড আতাহার ইসরাত রাফি।
এই মর্মান্তিক মৃত্যুগুলো একদিকে যেমন বেদনাদায়ক অন্যদিকে হাইকিং ও ট্রেকিং-এ উৎসাহী তরুণ প্রজন্মের জন্য নিরুৎসাহের কারণ। এই লক্ষ্যে দুর্ঘটনাগুলোর নেপথ্যের মূল কারণ এবং তা থেকে নিরাপদ থাকতে করণীয় নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের নিবন্ধ। চলুন, বর্ষাকালে হাইকিং ও ট্রেকিং-এ সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ এবং তা থেকে সতর্ক থাকতে জরুরি পদক্ষেপ জেনে নেওয়া যাক।
বর্ষাকালে হাইকার ও ট্রেকারদের মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণসমূহ
পিচ্ছিল ঝিরিপথ ও পাহাড় ধস
সারাদিন একটানা বৃষ্টিপাত উঁচু ঝর্ণার ধাপগুলোসহ ভেতরের পাহাড়ি ট্রেইলগুলোকে অত্যন্ত পিচ্ছিল করে রাখে। কাদা ও ভেজা শিলাগুলোতে যে কোনো মুহূর্তে পা পিছলে যেতে পারে। খুব কম হলেও পায়ের এখানে সেখানে শিলার ধারালো জায়গাগুলোতে লেগে জখম হতে পারে। এছাড়াও বৃষ্টির জমে থাকা পানি পাহাড়ি মাটির গঠনকে দুর্বল করে পাহাড়-ধস ঘটায়। এসব ভূমিধ্বস আকস্মিকভাবে চলাচলের পথ বন্ধ করে দিতে পারে। এমনকি প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই ধসের নিচে পড়ার মতো মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আরো পড়ুন: বান্দরবানের বাকলাই জলপ্রপাত ভ্রমণ: বাংলাদেশের অন্যতম সুউচ্চ ঝর্ণায় যাবার উপায় ও খরচ
আকস্মিক বন্যা
অতি বৃষ্টির ফলে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা নদী এবং ছোট খালগুলো ভরে ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে। এই আকস্মিক বন্যা ট্রেইলসহ সামনে পড়া সেতু এবং ক্যাম্পসাইটগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভেসে যাওয়ার সময় প্রবাহিত পানির চাপে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা পাথর বা ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ে। এর ফলে ট্রেকারদের ভয়ানক জখম হওয়াসহ মৃত্যুর হুমকি সৃষ্টি হয়।
ভারী বর্ষণে পথ খুঁজে পেতে সমস্যা
মুষলধারে বৃষ্টিতে এমনিতেই চারপাশের দৃশ্য আবছা হয়ে যায়। সেখানে ভারী বর্ষণে সর্পিলাকার ঝিরিপথ বা খালের সংকীর্ণ ধারাগুলো একেবারে অস্পষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে আবার নিরাপদ ট্রেইলের সাইনবোর্ডগুলো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি স্থানীয়রাও প্রায় ক্ষেত্রে অতি বৃষ্টির সময় বিড়ম্বনায় পড়ে যান। আর এই ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে জোর করে পথ চলা মানেই দিকভ্রান্ত হয়ে বিপজ্জনক রাস্তায় চলে যাওয়া।
ক্ষতিকর বন্যপ্রাণী
ভারী বৃষ্টিপাতের সময় মানুষের মতো বন্যপ্রাণীরাও বন্যা থেকে বাঁচতে আশ্রয় খুঁজে। এ সময় বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের মতো নানা ধরনের ক্ষতিকর বাস্তুচ্যুত বন্যপ্রাণী সামনে পড়তে পারে। চারপাশ পানিতে টইটম্বুর থাকার মুহূর্তে এগুলোকে শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এসময় অতর্কিতে এগুলোর যেকোনোটির ওপর একবার পা পড়া মানেই কামড় খাওয়া। এই বিষাক্ত আক্রমণে থাকে দ্রুত সংক্রমণের ভয়। আর প্লাবিত অবস্থায় এমন সংক্রমণে মাথা ঠান্ডা রেখে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার কথা ভাবা দুস্কর হয়ে ওঠে।
আরো পড়ুন: বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় ভ্রমণ: বাংলার দার্জিলিং যাওয়ার উপায় ও খরচের বৃত্তান্ত
অ্যাকিউট মাউন্টেন সিক্নেস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা
হাইট সিক্নেস, পোকামাকড় বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের তীব্র অ্যালার্জির মতো স্বাস্থ্য জটিলতা থাকা ব্যক্তিদের পর্বতারোহণ এড়িয়ে চলা উত্তম। বিশেষ করে বৃষ্টির সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে তীব্র মাউন্টেন সিক্নেসে আক্রান্তদের মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। অবিলম্বে এর চিকিৎসা না করা হলে আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে ও আর্দ্র অবস্থা তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকা ব্যক্তিদের প্রাণনাশের কারণ হতে পারে।
৫ মাস আগে
ট্রেকিং, হাইকিং, ক্যাম্পিং ও ভ্রমণের সময় সাপের কামড় থেকে নিরাপদে থাকার উপায়
ভ্রমণে ট্রেকিং, হাইকিং ও ক্যাম্পিংয়ের মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি। পাহাড়ের খাঁদ, ঝিরিপথ ও জঙ্গল ঘেরা আদিবাসীদের গ্রামগুলো বিচরণের সময় সবচেয়ে বেশি যে ঝুঁকি থাকে তা হচ্ছে বিষাক্ত সাপের উৎপাত। বিশেষ করে পাহাড়ি সাপের দংশনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তা গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে। ভ্রমণের আনন্দকে শতভাগ আরামদায়ক ও নির্ঝঞ্ঝাট করতে হলে সর্বাত্মকভাবে এই ধরনের ঝুঁকি এড়িয়ে চলা আবশ্যক। তাই চলুন, ভ্রমণের সময় সাপের কামড় থেকে দূরে থাকার উপায়গুলো জেনে নেই।
ভ্রমণের সময় সাপের কামড় থেকে দূরে থাকতে করণীয়
গন্তব্যে সাপের আনাগোনা সম্বন্ধে জেনে নেওয়া
প্রতিটি সফল ভ্রমণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার সুষ্ঠ পরিকল্পনা। গন্তব্য ঠিক করার মুহূর্তে ভ্রমণের যানবাহন, সেখানকার আবাসন, খাওয়া-দাওয়া যাবতীয় বিষয়ে বিশদ ধারণা নেওয়া হয়। এগুলোর সঙ্গে সাপ থেকে নিরাপত্তার দিকটাও অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ। যে অঞ্চলে যাওয়া হচ্ছে সেখানকার স্থানীয় সাপের প্রজাতির ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমন রাসেলস ভাইপার ও মনোক্লেড কোবরা সাধারণত গ্রামীণ অঞ্চলে বেশি থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায় সবুজ পিট ভাইপারের মতো প্রজাতি। এই সাপগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতে সক্রিয় থাকে এবং ধানের খেত বা জলাবদ্ধ এলাকায় বসবাস করে। এ ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে বাংলাদেশ বন বিভাগ, স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংস্থাসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকার ওয়েবসাইটগুলোতে।
আরও পড়ুন: বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার চেনার উপায় ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা
সাপ প্রতিরোধী পরিধেয়
লম্বা প্যান্ট, মোটা মোজা ও উঁচু বুটের মতো পরিধেয়গুলো সাপের কামড়ের ঝুঁকি কমাতে পারে। দুর্গম অঞ্চল পেরিয়ে ঝর্ণা দেখার সময় বা ম্যানগ্রোভ বন ভ্রমণকালে সুরক্ষামূলক গিয়ার পরিধান করা অপরিহার্য। এছাড়া এখন স্নেক গেটারের মতো নানা ধরনের অত্যাধুনিক সেফটি গিয়ার পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ ও সাপের আক্রমণের বিরুদ্ধে মজবুত ঢালের কাজ করে।
পাশাপাশি পরনে হালকা রঙের পোশাক থাকলে তা সাপ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক হতে পারে। কেননা বৈশিষ্ট্যগতভাবে সাপ উজ্জল রঙিন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়। বাংলাদেশে ট্রেকিং, ক্যাম্পিং ও হাইকিং জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বর্তমানে বিভাগীয় শহরগুলোতে অনেক ট্রাভেল শপ আছে। এই খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ট্রাভেল সরঞ্জামের পাশাপাশি বেশ কিছু স্নেক-সেফটি গিয়ারও পাওয়া যায়।
প্রাথমিক চিকিৎসা প্রস্তুতি
সাপের কামড় থেকে বাঁচার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে কামড়ের লক্ষণগুলো শনাক্ত করতে হয় এবং অবিলম্বে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য করণীয়গুলো জানা থাকা জরুরি। দংশনের পর শরীরজুড়ে বিষের বিস্তার কমানোর চেষ্টা করতে হবে এবং আক্রান্ত অঙ্গটিকে যথাসম্ভব স্থির রাখতে হবে। ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক এবং সম্ভব হলে সাকশন ডিভাইস ধারণকারী স্নেক বাইট কিট সঙ্গে রাখা উত্তম। রাঙ্গামাটি বা খাগড়াছড়ির পার্বত্য অঞ্চলের মতো এলাকায় পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিক উপযুক্ত প্রাথমিক চিকিৎসা যথেষ্ট সাহায্যে আসতে পারে।
নিরাপদ ট্রেইল অনুসরণ করা
জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোতে যেখানে অধিক লোক সমাগম হয় সেখানে ভ্রমণের সুবিধার্তে ঝুঁকিমুক্ত পথের নির্দেশনা দেওয়া থাকে। এই পথগুলো সাধারণত নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এরকম নির্দেশনা উল্লেখ করা সাইনবোর্ডগুলো একই সঙ্গে নিরাপদ ও সহজ ভ্রমণের নিশ্চয়তা দান করে। কোথাও হয়ত ঝোপঝাড় এতটা ঘন হয়ে গেছে যে তা বিচরণের অযোগ্য।
কোথাও বা খাড়া পিচ্ছিল ঢাল কিংবা স্বাভাবিক রাস্তা হলেও পথের প্রান্তে হয়ত রাস্তা শেষ বা অন্য কোনো রাস্তার সঙ্গে যোগসাজশ নেই। এ ধরনের রাস্তাগুলোতে প্রায়ই সাবধানতামূলক সাইনবোর্ড দেওয়া থাকে। অতিরিক্ত রোমাঞ্চের আশায় এগুলো উপেক্ষা করা মানেই ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ানো। এই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সাপগুলো অধিক সক্রিয় থাকে এবং এদেরকে শনাক্ত করাও বেশ কঠিন হতে পারে।
আরও পড়ুন: রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা
৫ মাস আগে
পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের করণীয়
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি হওয়ায় প্রাণোচ্ছ্বল গ্রহটির সৌন্দর্য্যের পরিমাণও যেন পানিতেই বেশি। আর তার টানেই বিশ্বব্যাপী ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান খাল-বিল, নদী-নালা ও সাগর সৈকতে। কিন্তু এই মায়ার ভেতরেও লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। মনোরম জলীয় সৌন্দর্য্যে অবগাহনের সময় এমনকি ছোট সুইমিং পুলটিও আশঙ্কাজনক বিপদগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তবে এটা দুঃখজনক যে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের পানিতে ডুবে মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।এরকম দুর্ঘটনা পরিবার তো বটেই, গোটা দেশবাসীর জন্য আশঙ্কাজনক।তাই প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনের সুষ্পষ্ট কারণগুলো যাচাই করা আবশ্যক। যে বিষয়গুলোর ওপর মানুষের হাত নেই, সেগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর জন্য ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন পূর্ব সচেতনতা। আর যে কারণগুলোর ওপর মানুষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার ওপর জোর আরোপ করা। আর এই লক্ষ্যেই এই নিবন্ধে পানিতে ডুবে মৃত্যু এড়াতে ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কিত নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। চলুন, সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলোর বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রতিরোধে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের জন্য ১৫টি টিপ্স
নির্ধারিত নিরাপদ অঞ্চলে সাঁতার কাটা
নিরাপত্তা ও উপভোগের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত এলাকায় সাঁতার কাটুন। সৈকত এবং নদীর তীরবর্তী স্থানে প্রায়ই বিভিন্ন সংকেতের পতাকা দেখা যায়। এগুলো সেই স্থানের দুর্ঘটনা প্রবণতা চিহ্নিত করে।
এ সংকেতগুলো মেনে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সাঁতার কাটা উচিত। এই সীমানাগুলো সাঁতারের জন্য শুধু নিরাপদই নয়; এগুলোর মাঝে থাকলে বিশেষত একজন যোগ্য লাইফগার্ডের সজাগ দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকা যায়।
সহসা কোনো অনিশ্চিয়তায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাঙায় ফিরে আসা
সাঁতার কাটার সময় চারপাশে অথবা নিজের শরীরে হঠাৎ কোনো অসঙ্গতি অনুভূত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ডাঙায় ফিরে আসুন। এটা হতে পারে স্রোত তীব্র হওয়া, প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়া কিংবা শরীরে হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি ভাব হওয়া।
কখনও কখনও আসন্ন কোনো বিপদের ব্যাপারে মন আগে থেকেই জানান দিতে শুরু করে। মনে রাখবেন, যে কোন সমস্যায় নিজের সহজাত প্রবৃত্তির ওপর বিশ্বাস রাখাটা বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের শীর্ষ ১৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থান
১ বছর আগে
সমুদ্রে স্নানের সময় সতর্ক থাকতে করণীয়
সমুদ্র ভ্রমণে উত্তাল ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেয়ার অমোঘ টান অনুভূত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই উচ্ছ্বাস অনেক সময় জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্র সৈকতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সমুদ্রে স্নানের সময় সতর্ক না থাকা, নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং সৈকতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এর জন্য দায়ী। তাই চলুন, সমুদ্রে স্নানের সময় মৃত্যুর কারণ ও দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক থাকতে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
সমুদ্রে স্নানের সময় দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর কারণ
পর্যটকদের সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনা উপেক্ষা
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নিষেধ সত্ত্বেও পর্যটকদের সমুদ্রের পানিতে নামা। গোসলের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলেও অনেকে ঝুঁকি নিয়ে আরো গভীরে চলে যান। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরেও দর্শনার্থীরা তা উপেক্ষা করেন। সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টেই এই বিড়ম্বনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি বিপজ্জনক সময়গুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার সময়েও কিছু পর্যটকদের সামাল দিতে যেয়ে রীতিমত ঝামেলার সম্মুখীন হন নিরাপত্তা কর্মীরা।
ফলশ্রুতিতে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। এছাড়া ভ্রমণের অফ সিজনে নির্জন সৈকতে পানিতে নেমেও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। এই অসতর্কতা ও নিরাপত্তাজনিত নির্দেশনা অমান্য করাই মুলত দায়ী প্রতি বছর মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জন্য।
আরো পড়ুন বাংলাদেশে ৩০০০ ফুটের অধিক উচ্চতার ১৪ পাহাড়
সৈকত নিরাপত্তা সংকেত সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব
সমুদ্রের মত বিপজ্জনক জায়গায় আগে থেকেই জোয়ার-ভাটার তথ্যটা সবার জেনে নেয়া উচিত। সৈকত প্রশাসন প্রতিটি বৈরী আবহাওয়ায় সতর্কতামুলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে সতর্ক সংকেত ও সংখ্যা দিয়ে বিপদের মাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা হয় জনসাধারণকে।
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই সংকেত বা সংখ্যার অর্থ অনেকেই জানেন না। কোন রঙের পতাকা কি অর্থ বহন করছে সে বিষয়ে অনেকেরই কোন স্পষ্ট জ্ঞান নেই। সৈকতের কোন কোন প্রবেশদ্বারগুলোতে সমুদ্রস্নানের নির্দেশনা থাকলেও তা একবারের জন্য পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না কেউ। ফলে অসতর্ক হয়েই সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাজারো দর্শনার্থী।
সমুদ্র সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা
উপরোক্ত দুটি কারণের পাশাপাশি এই কারণটি বিপদের ভয়াবহতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পর্যটকরা নিজেরা সতর্ক থাকলে বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো। কিন্তু হাজার হাজার অসতর্ক পর্যটককে সামলানোর জন্য বর্তমান লাইফগার্ড কর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট নয়। বিপুলসংখ্যক পর্যটকদের বিপরীতে মাত্র ১১২ জন টুরিস্ট পুলিশকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। কক্সবাজার সি সেইফ লাইফ গার্ড সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিদিনের দুই শিফটে মাত্র ২৭ কর্মী নিয়োজিত থাকেন।
আরো পড়ুন চট্টগ্রাম ভ্রমণ গাইড: ঘুরে আসুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্দর নগরী
তাছাড়া সৈকত এলাকায় পর্যাপ্ত নজরদারি ছাড়াও অভাব আছে উদ্ধার সরঞ্জামের। এরকম নাজুক ব্যবস্থায় ক্রমাগত দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে সৈকত।
সমুদ্রে স্নানের সময় কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার
দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা ও সময়ের ব্যাপারে আগে থেকেই জেনে রাখা
সমুদ্রস্নান করার জন্য এমন মৌসুমে যাওয়া উচিৎ যখন সমুদ্র শান্ত থাকে। এরপরেও অন্যান্য মৌসুমে যেতে হলে জোয়ার-ভাটার সময়গুলো ভালো ভাবে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। কক্সবাজারে পৌছার পর পরই স্থানীয়দের সাথে কথা বলে খোঁজ খবর করে নেয়া উচিত।
টুরিস্ট গাইড বা হোটেল বা স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা এবং তার স্পট সম্পর্কে জেনে নেয়া যেতে পারে। সৈকতে প্রবেশের মুখে উল্লেখিত নির্দেশনাগুলো মনযোগ দিয়ে একবার পড়ে নেয়া উচিত।
আরো পড়ুন ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজার: বাংলার ভেনিস বরিশালের সৌন্দর্য্যে সেরা সংযোজন
সাধারণত লাবণী পয়েন্ট ব্যতীত সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী, ডায়াবেটিস হাসপাতাল পয়েন্ট ও সিগাল পয়েন্টে গোসলে নামা নিষিদ্ধ থাকে। বিকেল ৫টার পর সমুদ্রের পানিতে নামা ঠিক নয়। এছাড়াও সমুদ্রে নামার আগে দিয়ে কর্মরত গার্ডের কাছ থেকে জোয়ার-ভাটাসহ আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থাটা জেনে নেয়া উত্তম। লাইফগার্ড নির্দেশিত স্থানগুলো ছাড়া অন্য কোনো পয়েন্ট থেকে সমুদ্রে গোসল করা ঠিক নয়। এমনকি সেখানে টায়ার বা যে কোন ভাসমান বস্তু নিয়েও পানিতে নামা উচিত হবে না।
সৈকতে বাতাসের গতিবিধি ও পানিতে নামা ঠিক হবে কি হবে না তা সহ যে কোন তথ্যের জন্য লাইফগার্ডরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকেন। যে কোন সময় তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করাটা উত্তম।
চিহ্ন এবং পতাকা ব্যাপারে জানা
সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পতাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো কখন ও কোথায় সমুদ্রের পানিতে যাওয়া নিরাপদ তার নির্দেশনা বহন করে। লাল রঙের পতাকা মানে সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। এগুলো ভাটার সময় লাগানো হয়। আর সবুজ পতাকার অর্থ এখন আপাতত সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ। এই পতাকা লাগানো হয় জোয়ারের সময় লাইফগার্ড এলাকায়।
আরো পড়ুন বান্দরবান ট্যুর গাইড: সেরা দর্শনীয় স্থানসমূহ
হলুদ পতাকা মানে সমুদ্রে ঢেউয়ের মাত্রা ১.৫ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। তাই পানিতে সাঁতারের সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
গোসলের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবুজ; সর্বোচ্চ হলুদ পতাকা লাগানো জায়গাগুলোতে থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই লাল পতাকা লাগানো জায়গা অতিক্রম করা যাবে না।
রিপ কারেন্ট থেকে সাবধান
রিপ কারেন্ট হল ঢেউয়ের শক্তিশালী অবস্থা যখন তা সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ঢেউ যে কোন দক্ষ সাঁতারুকেও খড়কুটোর মত দ্রুত সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এ সময় কোনভাবেই সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। যথাসম্ভব আগে থেকেই গার্ডদের কাছ থেকে রিপ কারেন্টের সময়ের ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।
আরো পড়ুন ঢাকার সেরা ১০টি জাদুঘর: ইতিহাস রোমন্থনের সঙ্গে জ্ঞান আহরণের অভাবনীয় সুযোগ
অনেক সময় আচমকাও রিপ কারেন্টের সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তীর রেখার সমান্তরালে থেকে তীরের দিকে সাঁতার দিতে হবে। তবে এ সময় সাহায্যের জন্য চিৎকার করাটাই ভালো। তাহলে আশেপাশের লোকজন সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারবে।
সমুদ্রের পানিতে নামার সময় টায়ার বা লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা
খুব ভালো সাঁতারুদেরও সমুদ্রের পানিতে নামার সময় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা উচিত। সমুদ্রের আবহাওয়া যে কোন সময় পরিবর্তন হতে পারে। টায়ার বা লাইফ জ্যাকেট থাকলে এ অবস্থায় বাঁচানোর সুযোগটা থাকে। আর যারা সাঁতার জানেন না, তাদের জন্য সমুদ্রের পানিতে না নামাটাই উত্তম। নিদেনপক্ষে, সমুদ্রের একদম কূল ঘেষে গোসল করা যেতে পারে, তবে সাবধান থাকতে হবে।
চোরাবালি থেকে সাবধান
সমুদ্রে তীব্র স্রোত এবং গুপ্ত গর্ত সৃষ্টি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। জোয়ারের সময় সমতল থাকা জায়গাগুলো ভাটার সময় খাদে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আর ঘূর্ণিপাকে সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর চোরাবালির। তাই এগুলো এড়িয়ে চলার জন্য লাইফগার্ডদের সাহায্য নিতে হবে। সবুজ পতাকা চিহ্নিত জায়গায় গোসল করা যেতে পারে। তবে সাবধানতার জন্য দলবদ্ধভাবে থাকা যেতে পারে, যেন কোন সমস্যা হলেই অন্যরা সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে।
আরো পড়ুন কমলদহ ও সহস্রধারা-২ ঝর্ণা ভ্রমণ গাইডলাইন: ভ্রমণপিপাসুদের প্রিয় ঝিরিপথ
শিশু ও বয়স্কদের একা হতে দেয়া যাবে না
সমুদ্রস্নানের ক্ষেত্রে এই দলবদ্ধ থাকাটা খুবই জরুরি। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের কোনভাবেই একা হতে দেয়া যাবে না। অসুস্থ বা দুর্বল শরীরের লোকদের নিয়ে সমুদ্রে হাঁটুপানির বেশি নামা যাবে না। তরুণদের মধ্যেও এরকম কেউ থাকলে বাকিদের উচিত তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও খাবার পানি রাখা
সৈকতে শঙ্খ, ঝিনুক জাতীয় জিনিসে লেগে অনেক সময় পা কেটে যায়। বিশেষ করে ইনানি সৈকতে এরকমটা বেশি দেখা যায়। এই পরিস্থিতির জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা বাঞ্ছনীয়। আর ক্লান্তি এড়ানোর জন্য সাথে রাখতে হবে খাবার পানি। কারণ পানের অযোগ্য সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পান হিতে বিপরীত করতে পারে। সর্বসাকূল্যে, ক্লান্ত বা ক্ষত নিয়ে সমুদ্রের পানির বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে।
পরিশিষ্ট
সমুদ্রে স্নানের সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক করণীয় সমূহ যথাযথ পালনের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাগুলো এড়ানো যেতে পারে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের জন্য সম্পদ, যা বিশ্ব পরিব্রাজকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলো তাদের কাছে এই সম্পদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করছে। তাই একদিকে সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি যেমন জরুরি, অন্যদিকে দেশীয় পর্যটকদেরও উচিত নিজের ও অন্যের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে সমুদ্র ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকা।
আরো পড়ুন হাকালুকি হাওর ভ্রমণ: এক নিঃসীম জলজ মুগ্ধতা
২ বছর আগে