আবুল হায়াত
মেহজাবীন অভিনীত ভিকি জাহেদের ‘তিথিডোর’ নিয়ে কেন এত আলোচনা
ঈদুল আজহা ২০২৪-এর চতুর্থ দিন ২০ জুন চ্যানেল আই প্রাইম ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পায় ‘তিথিডোর’। টেলিফিল্মটি ছিল রোমান্টিক-কমেডি নির্ভর ঈদ আয়োজনের একটি ভিন্ন পরিবেশনা। ভিকি জাহেদের নির্দেশনায় নাম ভূমিকায় দেখা গেছে ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীকে। তার সাবলীল অভিনয়ে টেলিফিল্মের সংবেদনশীল গল্প স্পর্শ করেছে দর্শকদের মন। মুক্তির পর থেকে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে গোটা সামাজিক মাধ্যম জুড়ে। চলুন, এই হৈচৈ-এর নেপথ্যের কারণটি জেনে নেওয়া যাক-
‘তিথিডোর’ নাট্য বৃত্তান্ত
চিরাচরিত নাট্যশৈলীর বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধারার নাটক নির্মাণে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সুপরিচিত নাম ভিকি জাহেদ। তারই পরিচালনায় টেলিফিল্মটির শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন মেহজাবীন চৌধুরী, আবুল হায়াত, প্রান্তর দস্তিদার, আশা মজিদ রোজী, শামীমা নাজনীন এবং শিশু শিল্পী দিবা সাজ্জাদ।
গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন জাহান সুলতানা। এছাড়া টেলিফিল্মের অন্যান্য কারিগরি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল ভিকির পুরনো টিম। তাদের মধ্যে চিত্রগ্রহণে ছিলেন বিদ্রোহী দীপন এবং সম্পাদনা, ভিএফএক্স, রঙ ও আবহ সঙ্গীত বিন্যাসে কাজ করেছেন অর্ণব হাসনাত।
আরও পড়ুন: ইতালির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হলো 'ময়না'
তিথিডোর: একজন নারীর জীবনের টানাপোড়েনের গল্প
সামাজিক নানা টানাপোড়েনের মাঝে নিশাত নামের ৩০ বছর বয়সী এক তরুণীর জীবনের মানে খুঁজে পাওয়ার গল্প তিথিডোর। শুরুটা হয় মুষলধারে পড়ন্ত বৃষ্টি দেখার সময় চায়ে সেই বৃষ্টির পানি মিশিয়ে তাতে চুমুক দেওয়া দিয়ে। এমন ভালো লাগা রোমান্টিক দৃশ্য ক্রমশ এগিয়ে ক্লাইমেক্সে উপনীত হয় চরম হতাশায়।
নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য সম্পর্কে জড়াতে দেখে নিশাতের পুরো পৃথিবীটা ধ্বংস হতে শুরু করে। বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে বিয়ে সংক্রান্ত বিড়ম্বনায় পরিবারের কাছেও ঠাঁই মেলে না তার। অন্যদিকে বিয়ের মিথ্যে নাটক সাজিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সে একা একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। ধীরে ধীরে বেঁচে থাকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলতে থাকে নিশাত।
ঠিক এমন সময়েই আকস্মিকভাবে আবির্ভাব ঘটে এক দেবশিশু- দিবার। নিশাত যে বিল্ডিংয়ে থাকে সে বিল্ডিংয়ে নতুন এসেছে। সব সময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটি দেখা হলেই নিশাতের মন খারাপের কারণ জানতে চায়। সে জানায় তার মা বলেছে, মন খারাপ থাকলে জীবনের সব সুন্দর জিনিসগুলোর লিস্ট করতে।
আরও পড়ুন: 'প্রিয় মালতী' হতে যাচ্ছে মেহজাবীন চৌধুরীর প্রথম সিনেমা
নিশাত যখন চূড়ান্তভাবে নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে উদ্যত হয়, তখনি সে জানতে পারে দিবা মরণব্যাধি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালে দিবাকে দেখতে গেলে শিশুটি তাকে বলে, এখন সে আর সেই লিস্ট করতে পারছে না। লিস্টে আরও সুন্দর জিনিস যোগ করতে তার নিশাতের সাহায্য দরকার। এই অনুরোধ রেখে এক সময় চলে মারা যায় শিশুটি। কিন্তু নিশাতকে দিয়ে যায় বেঁচে থাকার অমূল্য নির্যাস।
এই নির্যাসে এক চিমটি টনিক যোগ করে দেয় শামসুর রহমান নামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ। তার ভাষায়- ‘প্রতিটা বয়সেরই একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।’
তার সঙ্গে কথোপকথনে নিশাত বুঝতে পারে জীবন শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট পাওয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনটা অনেক বৈচিত্র্যময় এবং অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিসে ভরপুর। আর এই প্রত্যেকটি সৌন্দর্যের মূল্য রয়েছে। এই উপলব্ধির পর সব দুঃখ ভুলে নিশাত আনন্দের খোঁজার মাঝে দিন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
আরও পড়ুন: আসছে তাহসান-মিথিলার ওয়েব সিরিজ ‘বাজি’
দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার চিত্রপট
টেলিফিল্মটির পেছনে ভিকি জাহেদের নির্মাণশৈলী এবং মেহজাবীনের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসায় মুখর দেশের নেটিজেন পাড়া। সাম্প্রতিক সময়ের অভিনেত্রীর অধিকাংশ কাজগুলোর মতো এটিও ছিল গতানুগতিক ধারা বহির্ভূত।
চরিত্রের প্রয়োজনে বিষাদের প্রতিটি দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠেছে মেহজাবীনের অভিনয়ে। নারীপ্রধান টেলিফিল্মটির পুরোটাতেই মিশে ছিল নারীত্বের বিষণ্নতার আবহ। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে এরকম কাজের নজির খুব একটা দেখা যায় না। এমনি অনবদ্য পরিবেশনাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন নাট্যপ্রেমীরা। বিশেষ করে নারী দর্শকরা নিশাতের মাঝে অবিকল খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুঃখ-ভারাক্রান্ত বিষয়গুলো অগোচরেই থেকে যায়। মুখে হাসি রেখেও অনেক নারীই দিনের পর দিন বিষণ্নতাকে নীরবে বয়ে বেড়ান। এই টেলিফিল্মটি সেই সব নিঃশব্দ কান্নাকে যেন এক নিমেষে উগড়ে দেয়ার ইন্ধন জুগিয়েছে। সামাজিক মাধ্যম জুড়ে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নারী দর্শকদের মন্তব্যে।
আরও পড়ুন: ঈদুল আজহা ২০২৪ এ মুক্তির অপেক্ষায় কিছু চমকপ্রদ বাংলা নাটক
শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হলেও মানসিক স্বাস্থ্যের জটিলতাগুলো বরাবরই এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মনোকষ্ট যত ঘনীভূত হয়, ততই তা শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তাছাড়া আত্মহত্যার প্রবণতাও বর্তমান সমাজের একটি ভয়াবহ সমস্যা। এর নিরসনকল্পে অবিলম্বে হতাশার রসদগুলো আলোচনার মঞ্চে নিয়ে আসা জরুরি। ‘তিথিডোর’ যেন তারই এক মাইলফলক নাটকীয় মোড়কে।
সেই ধারাবাহিকতায় মেহজাবীন নিজেও একজন নারী অভিনেত্রী হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই এই কাজটি করেছেন। এ ধরনের গল্প যত মানব সম্মুখে আসবে তত এ নিয়ে কথা হবে। আর গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধানের মুখ দেখবে।
আর তাই জীবনযুদ্ধে জর্জরিত অনেক নারী দর্শক নিজেদের অনুপ্রেরণার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। বিশেষত সম্পর্কের জটিলতায় জর্জরিত মধ্যবয়স্ক নারীরা ব্যক্ত করেছেন সামাজিক মর্যাদা হারানোর কথা। একদিকে শরীরে বয়সের ছাপের সঙ্গে বাড়তে থাকা মানুষের কটু কথা, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের স্বনির্ভরশীলতা নিয়ে বিতর্ক।
আরও পড়ুন: কিরণ রাওয়ের ‘লাপাতা লেডিস’ নিয়ে যে কারণে এত আলোচনা
এই সূত্রে দর্শকদের মন্তব্যে আরও উঠে এসেছে মেয়ে সন্তানের প্রতি মা-বাবাদের বৈষম্যের কথা। তথাকথিত সামাজিক নিয়মের তাড়নায় এই একুশ শতকেও একটি মানব সত্ত্বা হিসেবে নারীদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকেও মেলে না কাঙ্ক্ষিত আচরণ।
প্রতিটি জীবনমুখী উপাদানের পরিবেশনার পর সুন্দর সমাপ্তিটা শুধু ভালো লাগাই দেয়নি, উৎসাহ জুগিয়েছে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের। মূলত এই বার্তাই পূর্ণতা দেয় একটি নাটকের। টেলিফিল্মটিকে বিশাল সেই অর্জনে ভূষিত করে একজন দর্শক ঐতিহাসিক শ্লোকের বেষ্টনীতে তার মন্তব্য আওড়েছেন এভাবে, ‘দুনিয়ায় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই আসল।’
শেষাংশ
সব মিলিয়ে ‘তিথিডোর’ ভিকি জাহেদের আরও একটি অনবদ্য নির্মাণ, যা আরও গভীরতা দিয়েছে মেহজাবীন চৌধুরীর বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয় নৈপুণ্যে। আর এই নির্মাতা-অভিনেত্রীর জুটির ভূমিকায় প্রাণ পেয়েছে হাজারও নারীর হৃদয় নিঙড়ানো আর্তনাদের গল্প। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একজন আশাহত নারীর নিঃশব্দ দিনাতিপাতের কেবল অকাট্য পরিবেশনাই নয়, টেলিফিল্মটির সফলতা ছিল একটি ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছানো। আর তাই দর্শকরা নিজের জীবনের সঙ্গে শুধু মিলই খুঁজে পাননি, সেই সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে ফিরে খুঁজে পেয়েছেন সঠিক পথটি।
আরও পড়ুন: ঈদুল আজহা ২০২৪ এ বাংলাদেশি যেসব সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায়
৪ মাস আগে