স্পঞ্জ সিটি
স্পঞ্জ সিটি: ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বন্যা-জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান
অনিয়ন্ত্রিত নগর ও শিল্পায়নের নিষ্পেষণে প্রতি বছরই বৃষ্টির মৌসুমে দেশের অধিকাংশ শহরগুলোর প্রধান সমস্যা থাকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, যাতায়াত সমস্যা, মশা ও রোগের উপদ্রব- সব মিলিয়ে জনজ্জীবন রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে। এই স্থবিরতায় গতি ফেরাতে পারে ‘স্পঞ্জ সিটি’। উদ্ভাবনী ধারণাটি ইতোমধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কার্যকরভাবে পানি অপসারণের কাঙ্ক্ষিত সুফলও মিলছে সেই সঙ্গে। কী এই স্পঞ্জ সিটি, এই ধারণার উৎপত্তিই বা কোথায়- সেসব বিষয়ে বিশদ আলোচনার পাশাপাশি চলুন জেনে নেই কীভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের বন্যা ও জলাবদ্ধতা সমস্যা মোকাবিলা করা যেতে পারে।
স্পঞ্জ সিটি কী
বন্যা ও জলাবদ্ধতা প্রশমিত করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও অপসারণের বিভিন্ন পদ্ধতিকে সামগ্রিকভাবে ‘স্পঞ্জ সিটি’ বলা হয়। এখানে মূলত পানি নিষ্কাশনের উপযোগী রাস্তাঘাট নির্মাণ, সবুজায়ন ও পানি সঞ্চয় ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর পানিচক্রকে অনুসরণের চেষ্টা করা হয়।
স্পঞ্জ সিটি ধারণার প্রবর্তন করেন চীনা ল্যান্ডস্কেপ স্থপতি ও অধ্যাপক কংজিয়ান ইউ। শৈশবে একবার তিনি ধানখেতে কাজ করার সময় বন্যায় প্রায় ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে যান। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাটিই মূল রসদ জুগিয়েছে পরবর্তীতে তার প্রকৃতি-বান্ধব নগরায়ন নিয়ে কাজ করার।
পূর্বে এ নিয়ে তার বেশ বিশদ গবেষণা থাকলেও ধারণাটি দৃশ্যমান হয় ২০০০ সালে বেইজিং ঝংগুয়ানকুন লাইফ সায়েন্স পার্ক নির্মাণের সময়। এখানে ব্যবহৃত ব্যবস্থাটির নাম ছিল ‘আর্থ-লাইফ সেল্স’, যেখানে জলাভূমি তৈরির মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে তা বিশুদ্ধ করা হয়েছিল। এর ফলে শহরের নির্ভরযোগ্য পানি ব্যবস্থাপনা গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রচিত হয়।
আরও পড়ুন: সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ঢাকায় জলাবদ্ধতার ভয়ংকর রূপ
স্পঞ্জ সিটি যেভাবে কাজ করে
এখানে জলাবদ্ধতা বা বন্যা সমস্যা নিরসণ এবং পানির গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বৃষ্টির পানিকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো হয়। স্পঞ্জ নগরায়নের একটি পদ্ধতি হচ্ছে একদিকে রাস্তাঘাট পানি প্রবেশের উপযোগী করে তোলা, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণ করা। এতে করে নানা দুর্যোগে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের স্থানগুলো দিয়ে সরাসরি সেই জলাধারে জমা হতে পারে। এই পানি পরবর্তীতে শহরের বিভিন্ন কাজে লাগার পাশাপাশি উষ্ণ মৌসুমগুলোতে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখে।
আরেকটি উপায় হচ্ছে সড়ক ও ভবন সবুজায়ন। এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদগুলো বৃষ্টির পানি শোষণ করে ও পানি অপসারণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নেয়। ফলশ্রুতিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে না।
এছাড়া কৃত্রিম জলাভূমি বানিয়ে তার চারপাশে রেইন গার্ডেন বা বৃষ্টি বাগান সাজানো হলে, তা ঝড়-বৃষ্টির সময় পানি বিশোধনে কাজে লাগে। এই বাগানগুলো গড়ে তোলা হয় বাড়ির ছাদ, ফুটপাত ও গাড়ি চলাচলের পার্শ্ব রাস্তা এবং পার্কিং লটসহ বিভিন্ন সংকীর্ণ এলাকায়।
বৃষ্টি বাগান সাধারণত জলাভূমির চারপাশজুড়ে সাজানো হয়, যেখানে থাকে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা। এগুলো পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টি সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প ছেড়ে দিয়ে চিরায়ত শ্বসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এ সময় উদ্ভিদগুলো আশেপাশের পরিবেশ থেকে তাপ টেনে নেয় বিধায় পরিবেশ ঠান্ডা থাকে।
আরও পড়ুন: জলাবদ্ধতা নিরসনে সমন্বিত উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস নেদারল্যান্ডসের
বিশ্বব্যাপী স্পঞ্জ সিটির প্রভাব
স্পঞ্জ সিটি ধারণার প্রবর্তক দেশ হিসেবে অভিনব কৌশলটি বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিক পালন করে আসছে পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন। উহান ও শেনঝেনসহ দেশটির ৩০টিরও বেশি শহর এই পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করেছে। ফলে এই শহরগুলোতে বন্যার মাত্রা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। একই সঙ্গে ব্যবহার্য পানির গুণগত মান উন্নয়নে সারা বিশ্বে তারা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে।
উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস অনেক আগে থেকেই তাদের দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচিত ছিল। সেখানে এই স্পঞ্জ সিটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে রটারড্যামের তৈরি জল প্লাজাগুলো ভারী বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই পানি শুষ্ক আবহাওয়ায় নগরের ভূ-ত্বকের তাপমাত্রা আরামদায়ক করে রাখে।
পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশ জার্মানিতে হামবুর্গের মতো শহরগুলো এখন স্পঞ্জ সিটির আওতাভূক্ত। হাফেনসিটি জেলায় ঝড়ের পানি ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে সবুজ ছাদ, পানির প্রবেশযোগ্য গ্রীড ফুটপাত ও বৃষ্টি বাগান। এগুলো যে শুধু জলাবদ্ধতাই কমিয়েছে তা নয়, সেই শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকেও উন্নত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস-অ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়ার মতো উন্নত শহরগুলো তাদের নামের সার্থকতা বজায় রেখেছে। নিউ ইয়র্কের ব্লুবেল্ট প্রোগ্রাম প্রাকৃতিক নিষ্কাশন করিডোর ব্যবহার করছে ঝড়ের পানি ব্যবস্থাপনার জন্য। ফিলাডেলফিয়ার গ্রিন সিটি ও ক্লিন ওয়াটার্স উদ্যোগগুলো পানিসহ বিভিন্ন পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা ছাড়াই নিশ্চয়তা দিচ্ছে শিল্পায়নের।
যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম শহর লন্ডন নাইন এলমস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব শহরায়ন নিশ্চিত করেছে।
ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী পূর্ব আফ্রিকার দুর্যোগপ্রবণ দেশ কেনিয়াও ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে সবুজ অবকাঠামো স্থাপনায়। তাদের আপ্রাণ চেষ্টার ফসল হচ্ছে কিটুই ও কাজিয়াদি শহরের রেইন গার্ডেন এবং সুপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলো।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত দাবদাহে যেভাবে ঘরের ছাদ ঠান্ডা রাখবেন
বাংলাদেশের বন্যা সমস্যা নিরসণে স্পঞ্জ সিটির কার্যকারিতা
ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণ
পানি না জমলে বা জমে থাকা পানি সরে গেলেই আর জলাবদ্ধতা বা বন্যার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু এই পানি সরে পড়ার জন্য প্রয়োজন বাধা-বিঘ্ন মুক্ত নির্দিষ্ট পথ, যেটি শেষ হবে নদীতে গিয়ে। পানি অপসারণের এই চ্যানেল তৈরিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে পারে ভূগর্ভস্থ জলাধার। এটি শুধু সরে পড়া পানিকে জায়গাই দিবে না, বরং সঞ্চিত পানিকে পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য রীতিমতো সম্পদে রূপ দিবে। এই পানি ব্যবহার করা যাবে আগুন নেভানোর কাজে। গরমের প্রচণ্ড দাবদাহে পানি ভর্তি জলাধার সাহায্য করবে ভূ-ত্বকের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে।
পানি প্রবেশযোগ্য ফুটপাত তৈরি
ছোট-বড় যেমনি হোক না কেন, মহাসড়কের দু’পাশের ফুটপাত পানি অপসারণের উৎকৃষ্ট জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। পায়ে চলাচলের এই রাস্তার গড়নে ব্যবহার করা যেতে পারে ছিদ্রযুক্ত কংক্রিট, ভেদযোগ্য অ্যাস্ফাল্ট ও ইন্টারলকিং পেভারের মতো উপাদানগুলো। এটি ফুটপাত ও প্রধান সড়কের সংযোগস্থলে থাকা অকেজো উন্মুক্ত ড্রেনের বিকল্প হতে পারে। বর্তমান ড্রেন ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট দূরত্বে দুয়েকটি গর্ত থাকায় ময়লা-আবর্জনা জমে পানি অপসারণের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রিড সিস্টেমের ফুটপাতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা নেই।
ছাদ সবুজায়ন
প্রতিদিন আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের কারণে এখন পথে ঘাটে গাছ লাগানোর জায়গা থাকে না। অবকাঠামো স্থাপনের জন্য উল্টো বরং অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভবনের ছাদকে সবুজ গাছপালা দিয়ে সাজিয়ে তোলা যেতে পারে। এই বাগানগুলোতে থাকা প্রতিটি উদ্ভিদ এবং মাটি পানি শোষণের প্রধান হাতিয়ার।
জলাবদ্ধতা দূরীকরণের পাশাপাশি সবুজ ছাদ বায়ুর গুণমান বৃদ্ধিতে বেশ কার্যকর। ঢাকার মতো উষ্ণ ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এই সবুজায়ন পদ্ধতি হতে পারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত উপায়।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত গরমে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়
বৃষ্টি বাগান ও জলাভূমি তৈরি
ঢাকার মতো শহরগুলোতে বৃষ্টি বাগানসহ জলাভূমির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া বেশ মুশকিল। কিন্তু এরপরেও নগরের পরিবেশ রক্ষার্থে এই কার্যক্রমটি অবশ্য করণীয়। পূর্বাচলের ৩০০ ফুট ইতোমধ্যে একটি দারুণ দৃষ্টান্ত উপস্থান করেছে। দৃষ্টি নন্দন উদ্যানের পাশে জলাভূমি তৈরি না করলেও দু’পাশের ১০০ ফুট প্রশস্ত খালগুলো রিটেনশন পন্ডের কাজ করে। কেননা আশেপাশের ছোট ছোট খালগুলোর পানি এই খাল দুটোতে মিশে বালু নদী পর্যন্ত চলে গেছে। এতে করে চওড়া রাস্তা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অন্যদিকে সবুজ উদ্যান স্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য পুরো সড়কটিকে পরিণত করেছে দর্শনীয় স্থানে।
বায়োসওয়েলস ও উদ্ভিজ্জ স্ট্রিপস স্থাপন
বিভিন্ন ধরনের দূষণ প্রশমণের সময় গাছপালা দিয়ে তৈরি নির্দিষ্ট আকৃতির চ্যানেল হচ্ছে বায়োসওয়েলস। এর মাধ্যমে ঝড়ের পানি শোষণ বা নির্দিষ্ট দিকে পরিবাহিত করা হয়, যেগুলো জমা হয় ভূগর্ভস্থ জলাধারে। বায়োসওয়েল দিয়ে পানি দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে না বিধায় পানিতে থাকা যাবতীয় দূষিত পদার্থ অপসারিত হয়ে যায়।
উদ্ভিজ্জ স্ট্রিপগুলোর উদ্দেশ্যও একই। খেতের সীমান্ত দিয়ে রোপণ করা স্ট্রিপগুলো আকৃতিতে আরও সংকীর্ণ হয়। এগুলোতে ব্যবহার করা উদ্ভিদগুলোর মধ্যে রয়েছে বহুবর্ষজীবী ঘাস বা শিম গাছ।
পরিশিষ্ট
ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বন্যা ও জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে স্পঞ্জ সিটি। পানি অপসারণে উপযোগী ফুটপাত, ভূগর্ভস্থ জলাধার, সবুজ ছাদ, বৃষ্টি বাগান, বায়োসওয়েলস ও উদ্ভিজ্জ স্ট্রিপগুলো সম্মিলিতভাবে উন্নত পরিবেশ গঠনের সহায়ক।
পানির গুণমান বৃদ্ধির পাশাপাশি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশের জন্য অতীব জরুরি। সেই সঙ্গে ব্যবহারিকভাবে স্বীকৃত এই তত্ত্বের বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত রয়েছে পরিবেশ দূষণ এড়িয়ে শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা।
আরও পড়ুন: তীব্র গরমে পানিশূন্যতা প্রতিরোধে উপকারী শাকসবজি
৪ মাস আগে