নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র
কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায়
যেকোনো কর্মক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক কর্মীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর এই অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে কর্মের সহায়ক পরিবেশ। সর্বাঙ্গীনভাবে ব্যক্তি মর্যাদা ও নিরাপত্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কাজের উপযোগী পরিবেশ। কিন্তু শিক্ষা ও সভ্যতার মেলবন্ধনে গঠিত কর্মযজ্ঞে বারবার আশঙ্কার সম্মুখীন হয়েছে নারীর নিরাপত্তা। অথচ নারীরা তাদের যোগ্যতা ও শ্রম দিয়ে যেকোনো গঠনমূলক কাজে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন আত্মমর্যাদা নিয়ে দক্ষতা প্রয়োগের সহায়ক পরিবেশ থাকা। এই পরিপ্রেক্ষিতে চলুন, নারীদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
যে ১০টি উপায়ে নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা যায়
হয়রানি ও বৈষম্যবিরোধী নীতি প্রয়োগ
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৩৩২ ধারা অনুযায়ী যেকোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত নারীর সঙ্গে তার সম্মানের পরিপন্থী, অশালীন বা অশ্লীল হিসেবে গণ্য হতে পারে এমন আচরণ করা যাবে না।
এই আইনের রূপরেখায় নারীদের প্রতি হয়রানি ও বৈষম্য প্রতিরোধের জন্য কোম্পানি নীতিমালায় সুস্পষ্ট নীতি ও নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এখানে নারীর আত্মমর্যাদা হানিকর প্রতিটি অনুপযুক্ত আচরণের স্বচ্ছ বিবৃতি থাকবে। একই সঙ্গে বিধি লঙ্ঘনের পরিণতিগুলোও বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। অতঃপর নির্ধারিত বিধিমালা স্তর ও পদ নির্বিশেষে সব কর্মচারীদের জানানো এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: স্মার্টফোনে ভূমিকম্প সতর্কতা চালু করবেন যেভাবে
পৃথক নারী নিরাপত্তা সেল গঠন
নারী কর্মচারীদের সুরক্ষায় হুমকিজনক বিষয়গুলো বহুমুখী হয়। তাই তার তদারক প্রক্রিয়া এবং নিরসন পদ্ধতিও ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোত্তম হচ্ছে একটি নিবেদিত নারী সুরক্ষা সেল তৈরি করা। এই পরিষদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল থাকা উচিত। এর আওতায় নানা ধরনের অভিযোগ নিষ্পত্তি, আইনি পরামর্শ, তদন্ত ও শাস্তি প্রদান এবং মানসিক সহায়তা বা কাউন্সিলিং অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে নারী কর্মচারীরা নিঃসঙ্কোচে, সহজভাবে এবং নির্ভরতার সঙ্গে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।
মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্ম-সংস্কৃতি বাস্তবায়ন
একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি পরিষদে নারী ও পুরুষের সংখ্যার মধ্যে সমতা বিধান করা জরুরি। বিশেষ করে উচ্চপদস্থ জায়গাগুলোতে নারীদের উপস্থিতি নারী চাকরিপ্রার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্তির অনুভূতি সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো প্রভাবশালী পদে থাকায় নারী কর্মকর্তা পুরো প্রতিষ্ঠানের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন। এই বিষয় কর্মক্ষেত্রে আচরণবিধি প্রতিষ্ঠার জন্যও জরুরি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত কর্মসংস্কৃতির দৌলতে প্রতিটি নবনিযুক্ত কর্মচারী বুঝতে পারে যে, তাদের কাছ থেকে কী আচরণ প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তারা এও বুঝে যায় যে, কোন আচরণের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে।
পূর্ব প্রতিষ্ঠিত আচরণবিধি পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এখানে স্বতঃস্ফূর্ততা আনতে ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের উন্মুক্ত এবং উদার হওয়া অপরিহার্য। নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে স্বচ্ছ যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায়ে সহায়ক হয়।
আরও পড়ুন: নারীদের চেয়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি যে কারণে
বেনামী অভিযোগের ব্যবস্থা গ্রহণ
প্রায় ক্ষেত্রে নারী কর্মচারীরা সহকর্মী বা বসদের অসংযত আচরণে লজ্জা ও আরও বেশি সম্মান হানির আশঙ্কায় আত্মপ্রকাশে অনীহা পোষণ করে। এমনকি ভুক্তভোগীদের চাকরি হারানোর ভয় থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো অগোচরেই থেকে যায়। তাই এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা উচিত যেখানে পরিচয় গোপন রেখেই অভিযোগের সুযোগ থাকবে। প্রথমেই জনসমক্ষে না এনে গোপনে চালিয়ে যেতে হবে প্রাথমিক তদন্ত। এতে নারী কর্মীরা অকপটে নিজেদের প্রকাশ করতে পারবে। অধিকন্তু, এ বিষয়ে স্বয়ং নারী কর্মচারীরা কী ভাবছে তা বোঝার জন্য একটা সমীক্ষা চালানো যেতে পারে। এর মধ্য দিয়েও বেরিয়ে আসতে পারে নানা ধরনের প্রতিকূলতা।
নিরাপত্তা লঙ্ঘনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণ
এ ধরনের হয়রানিগুলোর জন্য কোনো বিচারই পাওয়া যাবে না; এরকম চিন্তা থেকেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো আর প্রকাশ করা হয় না। এছাড়া দীর্ঘ প্রোটোকলের কারণে অনর্থক সময়ক্ষেপণের ফলে আস্থা হারিয়ে ফেলে ভুক্তভোগীরা। অন্যদিকে অপরাধী ব্যক্তি তার বিকৃত মানসিকতা অব্যাহত রাখতে সাহস ও প্রশ্রয় পেয়ে যায়।
তাই কালক্ষেপণ না করে নিয়োগকর্তাদের অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবশ্যই অভিযুক্তের নিকট স্বচ্ছ হতে হবে। নিছক কোনো ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় এড়ানো অথবা প্রতিষ্ঠানে সুনামের কথা ভেবে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা অন্যায়েরই নামান্তর। বরং দুষ্কৃতিকারীকে প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও পড়ুন: মোবাইল ফোন হ্যাকিং প্রতিরোধে করণীয়
এতে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের প্রতি নারী কর্মীদের নির্ভরতা বাড়বে, অন্যদিকে শাস্তি দেখে অন্যান্যরাও সাবধান হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রকাশ্য শাস্তির বিধান ভবিষ্যতে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
নিরাপদ পরিবহন বিকল্প
৯টা থেকে ৫টার অফিস প্রথায় স্বাভাবিকভাবে কাজ শেষে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কাজের প্রয়োজনে অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকতে হয়। তাই নিদেনপক্ষে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে নারী কর্মচারীদের জন্য কোম্পানির নিজস্ব পরিবহন দেওয়া উচিত। প্রতিদিন কাজ শেষে ভয় নিয়ে বাসায় ফেরাটা মানসিক অসুস্থতার দিকে পরিচালিত করে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরের দিন কাজের ওপর। তাই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই নারী কর্মীদের যাতায়াতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া আবশ্যক।
এখানে একদম সুস্থভাবে বাসায় ফেরাটা নিশ্চিত করা উচিত। গণপরিবহন নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দেওয়ার পর সেখান থেকে বাসায় ফেরার রাস্তাটি অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকে না। তাছাড়া মহাসড়কগুলো জনাকীর্ণ এবং প্রচুর আলোকিত থাকলেও আবাসিক এলাকার গলিগুলো কখনো কখনো অন্ধকার থাকে। কর্মচারীদের জন্য কমন পরিবহন দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।
আরো পড়ুন: ইসরো চন্দ্রযান-৩: ভারতের চন্দ্র বিজয়ে নারী বিজ্ঞানীদের সাফল্য
শক্তিশালী নিরাপত্তামূলক অবকাঠামো গঠন
নিয়োগকর্তাদের সিসিটিভি ক্যামেরা, অ্যাক্সেস কন্ট্রোল সিস্টেম এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের দিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এই অবকাঠামো নির্জন সময়গুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অপরাধ তদন্তের জন্যও প্রয়োজন। তাছাড়া এই সতর্কতার মাধ্যমে বাইরের সহিংসতা থেকেও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সুরক্ষিত করা যায়।
নারী কর্মচারীদের জন্য পৃথক ওয়াশরুম ও কমন রুমের ব্যবস্থা
দিনের একটা বিরাট সময় অতিবাহিত করা হয় অফিসে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রাইভেসি রক্ষার্থে অফিসে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের জন্যও পৃথক কমন রুম ও ওয়াশরুম থাকা দরকার। এই স্বাচ্ছন্দ্যটুকু না থাকলে কর্মক্ষেত্রটি অনায়াসে অস্বস্তির জায়গায় পরিণত হয়। তবে এটি শুধু নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটিই পরিপূর্ণ করে না, বরং এটি তাকে সম্মানিত করার শামিল। এর ফলে তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিজের বাড়ির কাজ করার অনুভূতি পায়। অন্যদিকে, এই সুবিধা না থাকা নিতান্ত লিঙ্গ-বৈষম্যের নামান্তর।
সতর্কতা ও নিয়ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান
মানবসম্পদ বিভাগ বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা প্রধান দায়িত্বে থাকলেও নারী কর্মীদের সুরক্ষার দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখা তাদের পক্ষে বেশ জটিল। এখানে দরকার দায়িত্বের বিকেন্দ্রিকরণ। এর মাধ্যমে মুখ্য দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি অন্যান্য কর্মচারীরাও নিরাপত্তা তদারকের ব্যাপারে সতর্ক হয়। এই কৌশল অবলম্বনের সর্বোত্তম পন্থা হলো কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে কাজের ফাঁকে পৃথক সেশনের মাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম-নীতি প্রণয়নের বিষয়গুলো কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: লবিং-রেফারেন্স ছাড়াই চাকরি পেতে প্রয়োজনীয় কিছু দক্ষতা
এভাবে প্রতিটি নারী কর্মী পরস্পরের দিকে খেয়াল রাখতে পারবেন। এছাড়া পুরুষ কর্মীরাও কাজের পরিবেশ বজায় রাখাতে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারবেন। এভাবে বিধিমালার ব্যাপারে সতর্ক কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। পরবর্তীতে তারাই নবনিযুক্তদের কোম্পানি সংস্কৃতি ও নিয়ম-নীতি শিখিয়ে দিতে পারেন।
পিয়ার সাপোর্ট এবং বাডি সিস্টেম
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সময়োপযোগী কর্মসংস্কৃতি হচ্ছে এই বাডি সিস্টেম বা পিয়ার সাপোর্ট। এই গ্রুপভিত্তিক কাজের পদ্ধতিটি সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও নারীদের জন্য এটি বেশ উপযোগী। এর মাধ্যমে অফিস অ্যাডমিনের পক্ষ থেকেই নির্দিষ্ট প্রোজেক্টের জন্য একাধিক কর্মচারীকে নিয়ে একটি গ্রুপ করে দেওয়া হয়। প্রোজেক্টটির কাজগুলো তারা নিজেদের যোগ্যতাগুলো পরিপূরকভাবে শেয়ার করার মাধ্যমে সম্পন্ন করে।
এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা যেতে পারে নারী কর্মচারীদের নিরাপত্তা রক্ষায়। ওভার-টাইম এবং কাজের সূত্রে দূরবর্তী কোনো স্থানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকজনের একটি গ্রুপ করে দেওয়া যেতে পারে। তারা শুধু কাজের ক্ষেত্রেই নয়, নিরাপত্তাগত দিক থেকেও পরস্পরের প্রতি খেয়াল রাখবে। এই ব্যবস্থা কেবল তাৎক্ষণিক নিরাপত্তাই প্রদান করে না, বরং সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের অনুভূতিও তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে, যেকোনো বিপদে তারা একত্রিত থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে।
আরো পড়ুন: কীভাবে আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করবেন?
পরিশিষ্ট
সর্বসাকূল্যে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিরো টলারেন্স নীতি প্রণয়ন করা জরুরি। এই লক্ষ্যে নির্ভয়ে এবং নিঃসঙ্কোচে অভিযোগ করার সুযোগের পাশাপাশি যুগপৎভাবে পৃথক নিরাপত্তা সেল গঠন করা অপরিহার্য। এগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী অবকাঠামো কর্মক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নিরাপদ করে তুলতে পারে। অপরদিকে, পরিবহন সুবিধা, পিয়ার ও বাডি সিস্টেম সহায়ক হতে পারে কর্মক্ষেত্রের বাইরে নারীর অবাধ বিচরণে। উপরন্তু, প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ সর্বাত্মকভাবে এই ব্যবস্থাকে পরিণত করতে পারে নিয়মিত চর্চায়।
আরো পড়ুন: নারীর নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষায় মোবাইল অ্যাপ
৩ মাস আগে