শূন্য আয়কর রিটার্ন
অনলাইনে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার উপায়
প্রত্যেক টিন (টিআইএন বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) ধারীর জন্য আয়কর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। বিষয়টি কেবল করযোগ্যতার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। যে টিনধারী ব্যক্তি কোনো ধরনের উপার্জনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নন, তারও রিটার্ন দেওয়া আবশ্যিক। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকের আয়-ব্যয়ের বৈধতা এবং হিসাবের ব্যাপারে সরকারকে অবগত রাখা। যাদের আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে রয়েছে তারা কোনো রূপ কর না দিয়েই এই তথ্যাবলি সরকারের কাছে পেশ করতে পারেন। আর এটি এখন খুব সহজেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যায়। চলুন, অনলাইনে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।
শূন্য রিটার্ন কি
যে পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রূপ ট্যাক্স বা কর প্রদান ছাড়াই রিটার্ন জমা দেওয়া হয়, তখন তা শূন্য বা জিরো রিটার্ন হিসেবে অভিহিত হয়। মূলত করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকা আয়ের বিপরীতে প্রদানকৃত রিটার্নকেই শূন্য রিটার্ন বলা হয়। ট্যাক্স গ্রহণ বা কর অব্যহতি, রিবেট বা কর রেয়াত বা অগ্রিম প্রদানকৃত কর কিংবা এই সব শর্ত অনুসারে সামগ্রিক আয়ের ওপর আরোপিত কর কমে আসে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাবতীয় হিসাব-নিকাষের পর চূড়ান্ত প্রদেয় কর শূন্য চলে আসে। এমতাবস্থায় আয়, ব্যয়, সম্পত্তি ও ঋণের সমুদয় তথ্যাদি পেশ করে জিরো রিটার্ন জমা করা আবশ্যিক।
জিরো রিটার্ন জমা প্রদান কাদের জন্য প্রযোজ্য
.
টিনধারী নাগরিকদের করমুক্ত আয়ের সীমা নিম্নরূপ:
- নারী ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বার্ষিক আয় অনুর্ধ্ব ৪ লাখ টাকা- তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কম- ৫ লাখ টাকার কম আয় সম্পন্ন গেজেটভূক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা
উপরোক্ত ক্যাটাগরি ছাড়া বাকি সব স্বাভাবিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে
আরো পড়ুন: টিন সার্টিফিকেট বাতিল করবেন কিভাবে: শর্তসমূহ ও আবেদন পদ্ধতি
শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার অনলাইন পদ্ধতি
সাধারণ পদ্ধতি
প্রথমেই যথারীতি লগইন করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর ই-রিটার্ন প্ল্যাটফর্মে (https://etaxnbr.gov.bd/#/auth/sign-in)। প্রক্রিয়া শুরুর আগে আয়-ব্যয়, ঋণ ও সম্পত্তির সমর্থনে যাবতীয় প্রাসঙ্গিক নথিপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। এতে প্রতিটি তথ্য প্রদান যেমন নির্ভুল হবে তেমনি দ্রুততর হবে পুরো প্রক্রিয়াটি।
ডিজিটাল পরিসেবার সনাতন নিয়মানুযায়ী সিঙ্গেল বা এক পেজ এবং মাল্টিপল পেজ বা ডিটেইল দুই মাধ্যমেই শূন্য রিটার্ন জমা করা যায়।
এক পেজের রিটার্নের ক্ষেত্রে আয়, ব্যায় ও সম্পত্তি সবকিছু সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করতে হয়। এখানে তথ্য প্রদানের ভিত্তিতে হিসাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয় না। প্রতিটি তথ্য সরবরাহ করতে হয় টাইপ করে। করযোগ্য আয়ের ক্ষেত্রে ধার্য করা নির্দিষ্ট করের পরিমাণটিও একইভাবে উল্লেখ করে দিতে হয়।
সাধারণত আরোপযোগ্য করটি নির্ধারিত হয় মোট আয়ের ওপর ভিত্তি করে। অতপর এই অংশ থেকে কর রেয়াত বাদ দিয়ে হিসেব হয় প্রদেয় কর। জিরো রিটার্নের ক্ষেত্রে যেহেতু আরোপযোগ্য কর শূন্য, তাই পরবর্তী হিসেব ব্যতিরেকে প্রদেয় করও শূন্য রেখে দিতে হয়।
ডিটেইল রিটার্নের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রদান করা তথ্যানুযায়ী হিসাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়।
প্রথম প্রশ্নটির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে করযোগ্য আয় আছে কিনা তা নিরূপণ করা হয়। এর ওপর নির্ভর করে পরবর্তীতে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহের জন্য প্রাসঙ্গিক অপশনগুলোর কমবেশি হয়ে থাকে। কোনো আয় না থাকলে এই প্রশ্নের ঊত্তরে 'নো'তে টিক চিহ্ন দিতে হবে। এতে ডানপাশে থাকা আয়ের যাবতীয় সেকশন নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। তবে আয় থাকার পরেও তা করযোগ্য না হলে অথবা অব্যহতি বা রেয়াতের মাধ্যমে তার বিপরীতে শূন্য রিটার্ন প্রযোজ্য হয়। সেক্ষেত্রে বেছে নিতে হবে ‘ইয়েস’ ঊত্তরটি।
অ্যাসেস্মেন্ট শিরোনামের এই পেজটির অন্যান্য অপশনগুলো যেকোনো রিটার্ন প্রদানের নিয়মেই পূরণ করে দিতে হবে। ‘সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ’তে ক্লিক করার পর পরের পেজে আসবে ‘অ্যাডিশনাল ইনফরমেশন’। পূর্বের পেজে করযোগ্য আয়ের প্রশ্নের ঊত্তরে 'নো' বলা হলে এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিবেটে 'নো' অপশনটি নির্দিষ্ট হয়ে থাকবে। একই কারণে এই পেজে ন্যূনতম কর হিসাবের বেশ কিছু অপশন দেখাবে না। শুধু থাকবে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার এবং আইটি১০বি ক্যাটাগরি। এগুলোর প্রত্যেকটির জন্য যথাযথ তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
যাদের সম্পত্তি ও ঋণ রয়েছে তাদের জন্য আইটি১০বি সাবমিট করা উচিত। তারপর সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউতে ক্লিক করার পর আসবে ব্যয়ের হিসাবের পেজ। সেই সঙ্গে ডানপাশে আরও কিছু ট্যাব যুক্ত হয়ে যাবে। সেগুলো হলো- ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট এবং রিটার্ন রিভিউ। পূর্ব পেজে আইটি১০বি অ্যাক্টিভ রাখা হলে এই পেজে নতুন ট্যাব হিসেবে অ্যাসেট অ্যান্ড লায়াবিলিটিস থাকবে।
সম্পূর্ণ ফর্ম পূরণের পর ‘প্রসিড টু অনলাইন রিটার্ন’ এবং তারপর পরের রিভিউ পেজে ‘সাবমিট রিটার্ন’-এ ক্লিক করলে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন: অনলাইনে ই-টিন সার্টিফিকেট করার পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
সঞ্চয়পত্রে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নিয়ম
এক্ষেত্রে ডিটেইল রিটার্ন নির্বাচন দিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। করযোগ্য আয় আছে কিনা- প্রশ্নের ঊত্তরে ‘ইয়েস’ অপশনে টিক দিতে হবে। এর ফলে ডানপাশে সক্রিয় হয়ে ওঠা ‘হেড্স অফ ইনকাম’ থেকে ‘ইনকাম ফ্রম ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসেট্স’-এর পাশে টিক দিয়ে রাখতে হবে।
একই কারণে পরের ‘অ্যাডিশনাল ইনফরমেশন’ পেজে রেয়াতের অপশনটি সক্রিয় থাকবে। রেয়াত ক্লেইম করার জন্য এখানে ‘ইয়েস’ অপশন বেছে নিতে হবে। একই সঙ্গে আইটি১০বি ক্যাটাগরিকেও সচল রাখতে হবে।
‘ইনকাম’ পেজ-এ দেখা যাবে ‘এক্সপেন্ডিচার’ ও ‘রিবেটসহ’ অন্যান্য সাধারণ ট্যাবগুলো। এই পেজে প্রধান কাজ হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রদান করা।
‘কর রেয়াত’-এর পেজে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরির অধীনে ‘অ্যাপ্রুভ্ড সঞ্চয়পত্র’-এ টিক দিয়ে আবারও সঞ্চয়পত্রের তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। এখানে সঞ্চয়পত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত রেয়াতটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রদর্শিত হবে।
সঞ্চয়পত্রে রেয়াতের সর্বোচ্চ সীমা হলো ৫ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এর থেকে বেশি হলেও রেয়াত এই ৫ লাখই আসবে।
পরের পেজে ব্যয় হিসাবের পালা। এখানে স্থান পাবে সঞ্চয়পত্র থেকে মুনাফা লাভের সময় প্রদানকৃত উৎসে করের পরিমাণটি। ‘পেমেন্ড অফ ট্যাক্স অ্যাট সোর্স’-এর ঘরে মোট উৎসে কর দেখাতে হবে। এর মধ্যেই পূর্বে ‘ইনকাম’ পেজে উল্লেখ করা সঞ্চয়পত্রের উৎসে করও থাকবে।
পূর্বে যেহেতু আইটি১০বি সক্রিয় রেখে আসা হয়েছে তাই এবার যথারীতি আসবে ‘অ্যাসেট্স অ্যান্ড লায়াবিলিটিস’। এখানেও পাওয়া যাবে ‘ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসেট্স’-এর অপশন, আর এখানেও সঞ্চয়পত্রের তথ্যাদি পূর্বের অনুরূপ হতে হবে। পরবর্তী কাজ হচ্ছে সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য যাবতীয় সম্পদ ক্রয়ের তহবিলের উৎস পরিমাণসহ টাইপ করা।
সবশেষে সমন্বয়করণের সময় নির্ভুল হিসাবের নিমিত্ত্বে ‘ফান্ড আউটফ্লো’ এবং ‘সোর্স অফ ফান্ড’-এর পরিমাণের মধ্যে সমতা রাখতে হবে। তারপর ‘সেভ এ্যান্ড কন্টিনিউ’ দিয়ে সামনে এগোলে আসবে ‘ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট’-এর পেজ, যেখানে পরিশোধের জন্য চূড়ান্ত করটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উল্লেখ থাকবে।
প্রথমেই কর্তনকৃত উৎসে কর নিশ্চিত করতে চলতি অর্থ বছরে উৎসে কর দেওয়া হয়েছে কিনা-এই প্রশ্নের ঊত্তরে ‘ইয়েস’ দিতে হবে। অতঃপর ‘ট্যাক্স পেমেন্ট আপডেট স্ট্যাটাস’-এর অপশনে ‘ইয়েস’ ক্লিক করলে একটি লেজার পেজ-এ নিয়ে যাওয়া হবে।
এবার বামপাশের মেন্যু থেকে ‘ক্লেইম সোর্স ট্যাক্স’-এর অধীনে ‘সঞ্চয়পত্র’-এ যেতে হবে। এই পেজে কর্তন করা উৎসে করসহ সঞ্চয়পত্রের অন্যান্য তথ্যাবলি পুনরায় উল্লেখ করতে হবে। তারপর ‘সেভ’ করার পরে নিচে সঞ্চয়পত্র টিডিএস লিস্টে তথ্যগুলো এক সারিতে প্রদর্শিত হবে।
এরপর বামপাশের মেন্যুতে একদম নিচে ‘ট্যাক্স পেমেন্ট স্ট্যাটাস’-এ যেতে হবে। ফলে স্ট্যাটাস পেজ-এ উৎসে করের আপডেটটি এক নজরে দেখানো হবে।
এখন নিচে ডানদিকে ‘গো টু ই-রিটার্ন’-এ ক্লিক করে আগের সেই ‘ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট’ পেজে ফিরে যেতে হবে। এ সময় দেখা যাবে চূড়ান্ত প্রদেয় করের সেকশনে শূন্য হয়ে গেছে। অতঃপর ‘প্রসিড টু অনলাইন রিটার্ন’-এ ক্লিক করলে পরের পেজে এতক্ষণ ধরে প্রদান করা প্রতিটি তথ্য একসঙ্গে দেখাবে। পুরো রিটার্নে কোনো ভুল আছে কিনা তা একবার দেখে নিয়ে ‘সাবমিট রিটার্ন’-এ প্রেস করলেই কাজ শেষ।
আরো পড়ুন: ই-রিটার্ন: অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন যেভাবে
শেষাংশ
অনলাইনে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রধান শর্ত হলো টিনধারী ব্যক্তির মোট আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকা। এক পেজের রিটার্নের মাধ্যমে খুব কম সময়েই এই কার্যক্রমটি সম্পন্ন করে ফেলা যায়। এখানে প্রদেয় কর শূন্য করার জন্য কোনো সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাষের বিড়ম্বনা নেই। আর ডিটেইল রিটার্নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেকশনে সরবরাহ করা তথ্যগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যতা ও সঙ্গতি রাখা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত কর রেয়াত, অগ্রিম পরিশোধ করা কর এবং কর অব্যহতির তথ্যাবলি ই-রিটার্ন লেজারে আপডেট করে নেওয়া উচিত।
১৩ ঘণ্টা আগে