প্লাস্টিক দূষণ
প্লাস্টিক দূষণে বছরে দেড় লাখ কোটি ডলারের স্বাস্থ্যঝুঁকি
বিশ্ব এখন প্লাস্টিক দূষণের সংকটে রয়েছে, যা মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনার বরাতে রোববার (৩ আগস্ট) ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সংকটের কারণে জন্ম থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর ফলে প্রতি বছর অন্তত ১.৫ ট্রিলিয়ন (দেড় লাখ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষতি হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৫০ সাল থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন ২০০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৬০ সালের মধ্যে এটি তিনগুণ বেড়ে বছরে এক বিলিয়ন টনে পৌঁছাবে। সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান-টাইম ইউস) প্লাস্টিকের ব্যবহার—যেমন পানির বোতল ও ফাস্টফুডের প্যাকেট।
বর্তমানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্রে পর্যন্ত ৮০০ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পুনর্ব্যবহার হয় মাত্র ১০ শতাংশেরও কম।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্লাস্টিক শুধু ব্যবহারের সময়ই নয়, বরং এর কাঁচামাল (তেল, গ্যাস ও কয়লা) উত্তোলন, উৎপাদন, ব্যবহার ও বর্জনের প্রতিটি ধাপে মানবদেহ ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতে বায়ুদূষণ, বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শ এবং মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশের ঝুঁকি তৈরি হয়। এমনকি প্লাস্টিকে জমে থাকা পানি মশার প্রজননস্থল হওয়ায় রোগবাহী মশার সংখ্যাও বাড়ছে।
পড়ুন: দেশীয় প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ছত্রাকনাশক উদ্ভাবনের দাবি বাকৃবি গবেষকদের
এই পর্যালোচনার প্রধান লেখক ও বস্টন কলেজের শিশু ও মহামারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিলিপ ল্যান্ডরিগান বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর। এর বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক খরচ রয়েছে। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
প্লাস্টিকশিল্প ও পেট্রোস্টেট (জ্বালানিনির্ভর দেশ) গোষ্ঠীগুলোর দাবি, প্লাস্টিকের উৎপাদন নয় বরং পুনর্ব্যবহারই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাগজ, কাচ বা ধাতুর তুলনায় প্লাস্টিক সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। তাই কেবল রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৮ শতাংশ প্লাস্টিক জীবাশ্ম জ্বালানি—তেল, গ্যাস ও কয়লা থেকে উৎপাদিত হয়। এতে বছরে ২ বিলিয়ন টনের সমপরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ হয়। পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানে পুড়িয়ে ফেলা প্লাস্টিক থেকেও মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে।
বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যে ১৬ হাজারেরও বেশি রাসায়নিক উপাদান থাকে—যার মধ্যে আছে রং, ফিলার, ফ্লেম রিটারডেন্ট ও স্ট্যাবিলাইজার।
দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত পর্যালোচনায় বলা হয়, এসব রাসায়নিকের অনেকগুলোই মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গর্ভাবস্থায় এসব উপাদানের সংস্পর্শে গর্ভপাত, অপরিণত বা মৃত সন্তানের জন্ম, জন্মগত ত্রুটি, ফুসফুসের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া, শৈশবের ক্যানসার এবং পরবর্তী জীবনে প্রজনন সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।
পড়ুন: টেকসই বিনিয়োগে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি জরুরি: পরিবেশ উপদেষ্টা
প্লাস্টিক বর্জ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা পানি, খাবার ও বাতাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কণা মানুষের রক্ত, মস্তিষ্ক, বুকের দুধ, গর্ভনালির প্লাসেন্টা, শুক্রাণু ও অস্থিমজ্জায় পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
গবেষকদের মতে, এসব ক্ষুদ্র কণা স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি।
অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই ‘সস্তা’ উপাদান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিককে সাধারণত সস্তা উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর স্বাস্থ্যগত ক্ষতি বিশ্লেষণ করলে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শুধু তিনটি রাসায়নিক—পিবিডিই, বিপিএ ও ডিইএইচপি—ব্যবহারজনিত কারণে ৩৮টি দেশে স্বাস্থ্যক্ষতির বার্ষিক আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক সংকট মোকাবেলায় একটি বাধ্যতামূলক বৈশ্বিক চুক্তি নিয়ে শেষ ধাপের আলোচনা চলছে। যদিও ১০০টির বেশি দেশ প্লাস্টিক উৎপাদন সীমিত করার পক্ষে, তবে সৌদি আরবসহ কিছু তেলনির্ভর দেশ এতে বাধা দিচ্ছে।
পড়ুন: আমরা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছি: ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর আর্তনাদ
এই বিষয়ে পর্যালোচনার সহলেখক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মার্গারেট স্প্রিং বলেন, ‘এই প্রতিবেদনগুলো বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের জন্য নিরপেক্ষ ও তথ্যনির্ভর উৎস হয়ে উঠবে, যা কার্যকর নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করবে।’
১২৩ দিন আগে
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে আজ সারা বিশ্বে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিনটি। তবে ঈদুল আজহার ছুটির কারণে বাংলাদেশে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হবে আগামী ২৫ জুন।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’। এ প্রতিপাদ্যের মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য যে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা ও কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিবছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথমবার এই দিবসটি পালিত হয় এবং বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এটি উদযাপন করা হয়।
আরও পড়ুন: জাতীয় পরিবেশ পদক পাচ্ছেন ৩ ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠান
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল লক্ষ্য হলো— পৃথিবী ও প্রকৃতিকে রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং পরিবেশবান্ধব জীবনের চর্চা বাড়ানো। প্রতিবছরই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে এই দিবসটি উদযাপিত হয়।
বিশ্বব্যাপী চলমান প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় এ বছরের প্রতিপাদ্যকে সময়োপযোগী ও জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন পরিবেশবিদরা।
১৮৩ দিন আগে
প্লাস্টিক দূষণ রোধে দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ডাক বাংলাদেশের
দক্ষিণ এশিয়ার নদনদী ও সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ রোধে আঞ্চলিকভাবে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
সোমবার(৭ এপ্রিল) শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত 'প্লাস্টিক-ফ্রি রিভার্স অ্যান্ড সিজ: এ ভিশন ফর সাউথ এশিয়া রিজিওনাল রাউন্ডটেববিল'র ‘পলিসি অ্যান্ড রেগুলেটরি চ্যালেঞ্জেস অব ম্যানেজিং প্লাস্টিক ওয়েস্ট’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এ আহ্বান জানান।
ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্যবস্থার আবাসস্থল। এখানকার জলাধারে প্লাস্টিক সীমান্ত পেরিয়ে এসে জমা হয় এবং বাস্তুতন্ত্র ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে।’
তিনি বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধানে দরকার সমন্বিত আঞ্চলিক কৌশল—যেখানে সহযোগিতা, উদ্ভাবন ও টেকসই অর্থায়ন থাকবে।’
পরিবেশ সচিব বলেন, প্লাস্টিক দূষণ সমস্যা মোকাবিলায় তিনটি প্রধান বাধা রয়েছে— অপ্রতুল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যেমন উন্মুক্তভাবে ফেলা ও পোড়ানো; দুর্বল আইন বাস্তবায়ন; তথ্য বিনিময় ও যৌথ পরিবীক্ষণে আঞ্চলিক সহযোগিতার ঘাটতি।
আরও পড়ুন: জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন চলমান থাকবে: পানি সম্পদ উপদেষ্টা
তিনি একটি দক্ষিণ এশীয় বহু খাতভিত্তিক প্লাস্টিক কর্মপরিকল্পনা গঠনের প্রস্তাব দেন। এই পরিকল্পনায় থাকবে—বৃত্তাকার অর্থনীতির জন্য সমন্বিত নীতি, প্লাস্টিক উৎপাদন হ্রাসে অভিন্ন মানদণ্ড এবং গ্লোবাল প্লাস্টিকস চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি।
আঞ্চলিকভাবে বর্জ্য সংগ্রহ, আলাদা করা ও প্রক্রিয়াকরণে যৌথ উদ্যোগ এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের আহ্বানও জানান পরিবেশ সচিব ফারহিনা।
তিনি বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর প্লাস্টিক ধাপে ধাপে বন্ধ করার পাশাপাশি নিরাপদ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্প ব্যবহারের আহ্বান জানান।
পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আঞ্চলিক প্লাস্টিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থা, হটস্পট পরিষ্কারের কর্মসূচি ও আইনের কঠোর প্রয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অঞ্চল উপযোগী গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। জনসম্পৃক্ততা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও দরকার।’
তিনি এক্সটেন্ডেড প্রোডিউসার রেস্পন্সিবিলিটি (ইপিআর) মডেলের ওপর জোর দেন, যাতে শিল্পকারখানাগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আলাদা চেষ্টা যথেষ্ট নয়। এখনই সময় সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার। আমরা সাহসী সিদ্ধান্ত নেব, প্লাস্টিকমুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একসঙ্গে কাজ করব।’
ড. ফারহিনা আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন—পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শামীমা বেগম এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রাজিনারা বেগম।
এই গোলটেবিল বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন।
২৪১ দিন আগে