বন্ধ হাসপাতাল
ছুটিতে বন্ধ হাসপাতাল, দুর্ভোগ লাঘবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা
ঈদের ঠিক দুইদিন আগে, যখন উৎসবের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে রাজধানী, তখন অন্ধকার নেমে আসে জামাল আহমেদের জীবনে। রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হিসেবে কর্মরত জামাল (ছদ্মনাম)। একাধিক আঘাত ও হাড় ভেঙে যাওয়ার পর তাকে তড়িঘড়ি করে কাছাকাছি একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা পান এবং বিলম্ব না করে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য বলা হয় তাকে।
কিন্তু বাংলাদেশে ঈদের সময় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পাওয়া যেন সোনার হরিণের পিছনে ছোটার মতো। অবশ্য জামালের কপাল মন্দ নয়। তিনি দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে একজন অস্থি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান। ঠিক সময়ে ক্লিনিকে পৌঁছেও জামাল পড়ে যান অসংখ্য রোগীর ভিড়ে। আহত বা অসুস্থ মানুষদের নীরবে যন্ত্রণায় অপেক্ষা করতে দেখেন তিনি। বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে জামাল সেখানে দীর্ঘ দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেন, এই আশায় যে কখন তার ডাক পড়বে।
তবে এ ধরনের দুর্ভোগ বাংলাদেশর প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যতিক্রম নয়। সাধারণ দিনেও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কঠিন; আর ঈদের সময় তো কথাই নেই।
ঈদের খুশিতে দেশ যখন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে, তখন অনেক হাসপাতালই নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। চিকিৎসাসেবার ব্যস্ত গুঞ্জন চাপা পড়ে নিরব কান্না আর অবহেলিত রোগীর আহাজারিতে।
যে ক্লিনিকে জামাল অপেক্ষা করছিলেন, সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ চিকিৎসক অনুপস্থিত ছিলেন। তারা আনন্দে ঈদের ছুটি কাটাচ্ছেন। কিন্তু রোগীদের জন্য কোনো ঈদ নেই, নেই কোনো আনন্দ, কেবল যন্ত্রণা আর অশ্রুর মধ্যেই সহ্যের এক কঠিন পরীক্ষা।
আরও পড়ুন: এক সপ্তাহ পর চক্ষু হাসপাতালে জরুরি সেবা চালু
চলতি বছর বাংলাদেশে ৫ জুন থেকে টানা ১০ দিনের ছুটি শুরু হয়, যা সারা দেশকে এক উৎসবমুখর শান্তির আবরণে ঢেকে দেয়।
কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মতো জায়গায় এই শান্তি যেন অবহেলার অন্য নাম। হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া না গেলেও জরুরি সেবার চাহিদা জোয়ারের মতো বেড়েই চলেছে।
গোপনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়ে ফাঁকা করিডোর আর চিকিৎসকদের শূন্য চেয়ারের দৃশ্য।
প্রতিবারের মতো এবারও এই সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এগিয়ে এসেছে এবং একটি বিস্তৃত নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে ঈদের ছুটি রোগীদের জন্য অব্যাহত কষ্টে পরিণত না হয়।
ঈদ হোক বা না হোক — চিকিৎসাসেবা চলতেই হবে
ঢামেকের উপপরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসকদের ছুটি ভাগ করে দিয়েছি। জরুরি সেবা ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকবে।’
তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, ‘দীর্ঘ ছুটি ও ঢাকা মেডিকেলের চিরাচরিত রোগীর চাপ বিবেচনায় রেখে আমরা নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমানও একই ধরনের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘বহির্বিভাগের সেবা ৬ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তবে আইসিইউ, লেবার রুম, অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য জরুরি সেবা চালু থাকবে। ঈদের দিন রোগীদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। ৫ জুন নিয়মমাফিক সব সেবা চালু থাকবে এবং ৯ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত সব বিভাগ চালু থাকবে। ১৩ জুন হাসপাতাল বন্ধ থাকবে, তবে ১৪ জুন থেকে আবার খুলে যাবে, এমনকি অন্য অফিস বন্ধ থাকলেও শনিবারও খোলা থাকবে।’
আরও পড়ুন: চারদিন ধরে বন্ধ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, বিপাকে রোগীরা
এ ছাড়া, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য এবং দুটি মূল নির্দেশনা দিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য, যাতে সারা দেশে জরুরি চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত না হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান নির্দেশনাসমূহ সংক্ষেপে
• জরুরি বিভাগে ডিউটিতে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে — প্রয়োজনে অতিরিক্ত চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে।
• লেবার রুম, জরুরি অপারেশন থিয়েটার ও ডায়াগনস্টিক ল্যাব ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে।
• ঈদের আগে-পরে পর্যায়ক্রমে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত জনবল বজায় থাকে।
• প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জনস্বার্থ ও জরুরি সেবার ধারাবাহিকতা বিবেচনায় রেখে ছুটি অনুমোদন করতে হবে।
• জেলা পর্যায়ে কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে এবং সিভিল সার্জন বা বিভাগীয় পরিচালকদের আগেই জানাতে হবে।
• বিভাগীয় প্রধানদের প্রতিদিনের কার্যক্রম তদারকি করতে হবে এবং এক্স-রে ও ল্যাবসহ গুরুত্বপূর্ণ ডায়াগনস্টিক
সেবাসমূহ সচল রাখতে হবে।
• জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, স্যালাইন, রিএজেন্ট ও সার্জিকাল সরঞ্জামের পর্যাপ্ত মজুত থাকতে হবে।
• অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সর্বদা সচল রাখতে হবে।
• হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় বাধ্যতামূলক।
• অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
• প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ডিউটিরত স্টাফদের সঙ্গে যোগাযোগে থাকতে হবে এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হবে।
• যদি প্রধান কর্মকর্তা ছুটিতে থাকেন, তাহলে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে এবং তার যোগাযোগ তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
• ঈদের দিন ভর্তি রোগীদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেরা উপস্থিত থেকে তা বিতরণ নিশ্চিত করবেন।
• বহির্বিভাগ (ওপিডি) ৭২ ঘণ্টার বেশি বন্ধ রাখা যাবে না — কিছুটা নমনীয়তা রাখা হলেও মূল নিয়মটি বজায় থাকবে।
বেসরকারি হাসপাতালের জন্য নির্দেশনা
ক. নিবন্ধিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ২৪ ঘণ্টা জরুরি ও মাতৃত্বসেবা নিশ্চিত করতে হবে।খ. প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রয়োজনে রেফারকৃত রোগীর জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।গ. কোনো জরুরি অবস্থা বা দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ডিজিএইচএসকে জানাতে হবে।
ডিজিএইচএসের পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান ইউএনবিকে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় আমরা তাদের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে নিবন্ধিত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ২৪ ঘণ্টার জরুরি ও মাতৃত্বসেবা নিশ্চিত করা।’
অন্ধকারের মাঝে আশার আলোএই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে ঈদের ছুটিতে নিস্তব্ধ করিডোর, অশ্রুসজল অপেক্ষা, অবর্ণনীয় কষ্টের যে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় —— তা পরিবর্তিত হয়ে দায়িত্বশীল চিকিৎসাসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে বলে আশা করছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
আহমেদ ও তার মতো হাজারো মানুষের জন্য এক মুহূর্তের বিলম্বই সারাজীবনের কষ্টের কারণ হতে পারে। ছুটি যেন কখনোই সুস্থতার পথে বাধা না হয়। যখন জাতি ঈদ উদযাপন করছে, তখন হাসপাতালগুলোকে মনে রাখতে হবে — ব্যথা কখনো ছুটি নেয় না।
১৮০ দিন আগে