খুলনা, ১৫ অক্টোবর (ইউএনবি)- মাত্র ছয় লাখ গ্রাহক ছিল ২০১২ সালে। তখনকার অর্গানোগ্রামে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) মোট জনবল ছিল দুই হাজার ৬৯৮জন। ছয় বছর পর এসে এখন ওজোপাডিকোর গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে। এখনও সেই একই অর্গানোগ্রাম দিয়েই চলছে কোম্পানির কার্যক্রম। এর পরও মোট জনবল থেকে ৭৪২ জন লোকবল কম রয়েছে।
সেটআপের বিপরীতে কয়েকটি জায়গায় অতিরিক্ত লোকবল কর্মরত আছে এমনটিও বলা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কয়েক ধাপে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলেও এ পর্যন্ত কোনো কর্মচারী নিয়োগ হয়নি। বিশেষ করে অভিযোগকেন্দ্রগুলোতে অভিযোগ গ্রহণের জন্য অনেক সময় কোনো লোকই পাওয়া যায় না।
সব মিলিয়ে পদ্মার এপারের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ওজোপাডিকোর গ্রাহকসেবা কাগুজে সেবায় থাকলেও বাস্তবে নেই বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।
ওজোপাডিকোর সাথে সম্পৃক্ত একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই দফার মেয়াদে কোম্পানিতে কোনো কর্মচারী নিয়োগ হয়নি। পক্ষান্তরে কয়েক ধাপে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি কিছু পদে নিয়োগের জন্য আবেদন গ্রহণ করে ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছে। যাদের কাছ থেকে রীতিমত ব্যাংক ড্রাফটও নিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর।
কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় অভিযোগকেন্দ্রগুলো অনেক সময় অরক্ষিত থাকে। গ্রাহকরা ফোন দিলেও অভিযোগকেন্দ্রগুলোতে ফোন ধরারও লোক পাওয়া যায় না। কেননা একটি অভিযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কেন্দ্রটি বন্ধ করেই সেখানে যেতে বাধ্য হন। তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত নতুন কোনো অভিযোগ গ্রহণের কোনো লোকবল থাকে না বিধায় গ্রাহক ভোগান্তি এ ক্ষেত্রে প্রকট আকারে দেখা দেয়।
এছাড়া ওজোপাডিকোর ২১ জেলায় বর্তমানে ৬৭টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র থাকলেও সেগুলোতে সার্বক্ষণিক ডিউটির জন্যও নেই প্রয়োজনীয় জনবল। প্রতিটি উপকেন্দ্রে চারজন করে এসবিএ থাকার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশতেই দুই জনের বেশি নেই। এতে একজনকে অনেক সময় ১২ ঘণ্টাও ডিউটি করতে হয়। অথচ সে অনুযায়ী দেয়া হয় না প্রয়োজনীয় ওভারটাইমও।
ওজোপাডিকোতে জনবল সংকটের চিত্র তুলে ধরে ওজোপাডিকো বিদ্যুৎ শ্রমিক কর্মচারী লীগ (বি-২১৩৮)-সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক শেখ আলমগীর বলেন, ওজোপাডিকোর যাত্রা শুরুর পর এখন মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে অর্ধেকেরও কমে নেমে গেছে। অথচ কোম্পানি গঠন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়নি।
তিবি বলেন, বিশেষ করে সাহায্যকারী ও জেএএ পদে লোক নিয়োগের জন্য হাজার হাজার আবেদন নিয়ে সেগুলো বস্তাবন্দি করে রাখা হলেও এর পরে সহকারী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে লোক নিয়োগ দেয়া হয়। নিরাপত্তা প্রহরীরও ৩০০ পদ শূণ্য রয়েছে। তাছাড়া ২০১৬ সালে গাড়ি চালকের ২৬টি পদ শূন্য থাকার পরও ৩৪টি গাড়ি কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ গাড়ি চালক না থাকায় কোটি কোটি টাকার সম্পদও ধ্বংস হচ্ছে।
বিদ্যুৎ শ্রমিক কর্মচারী লীগের এই নেতা বলেন, কর্মচারী নিয়োগ না হলেও কয়েক ধাপে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি গ্রাহক সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণ। এজন্য কোম্পানির স্বার্থেই জরুরি ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগসহ ওজোপাডিকোর সকল অসন্তোষ দূর করতে বর্তমান কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা পালন করা উচিত। তা না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
ওজোপাডিকো শ্রমিক কর্মচারী লীগ (বি-২১৩৫)এর সভাপতি শেখ মকলুকার রহমান বলেন, ২০০৭ সালে যখন ওজোপাডিকোর যাত্রা হয় তখন ২ হজার ৭২৬জন জনবলের অর্গানোগ্রাম ছিল। তখন গ্রাহক সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ। আজ গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ হলেও পুরাতন সেট আপ দিয়েই কোম্পানির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
মৃত্যু অথবা অবসরজনিত কারণে বর্তমানে এক হাজারও কর্মচারী নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সংকট মোকাবেলায় তিনি ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, জনবল ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। নতুন অর্গানোগ্রাম তৈরির পাশাপাশি দ্রুত ওজোপাডিকোতে দ্রুত জনবল নিয়োগ দেয়া দরকার।
সরকারি দলের এ দু’টি শ্রমিক সংগঠন ছাড়াও পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (বি-২১৪০)এর সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবর রহমান বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কর্মচারীদেরও প্রয়োজন রয়েছে। সেটি বিবেচনায় এনে কোম্পানির স্বার্থেই কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কোম্পানিকে এগিয়ে নেয়া উচিত।
ওজোপাডিকোর সূত্র জানায়, কর্মচারী নিয়োগ না হলেও কয়েক ধাপে কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী নিয়োগ দিয়ে মাথাভারী প্রশাসনে পরিণত করা হয়েছে। যদিও এসব ক্ষেত্রেও অনেককে একাধিক জায়গায় দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে জনবল সংকটের কারণে। সহকারী প্রকৌশলী, সহকারী ম্যানেজার, উপ-সহকারী প্রকৌশলী এসব পদে লোক নিয়োগের জন্য ব্যাংক ড্রাফট নিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। এটিও আর একটি অমানবিক বিষয় উল্লেখ করে কয়েকজন জানান, একজন ব্যক্তির চাকরি হবে কি না সেটি না জানিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া ফ্রিজিং করে রাখাও আর একটি অনিয়ম। অর্থাৎ একদিকে নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য আবার কর্মচারী নিয়োগ না দিয়ে কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক নেতা জানান।
অপরদিকে, জনবল সংকট থাকায় ওজোপাডিকোতে একজন লোককে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মূল দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে ওজোপাডিকোতে চলমান কয়েকটি প্রকল্পের কাজে একই ব্যক্তিকে একাধিক দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে।
জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে ওজোপাডিকোর মহাব্যবস্থাপক (এইচআর এন্ড এডমিন) মো. আলমগীর কবির বলেন, কোম্পানির স্বার্থেই জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া কিছুদিন পিছিয়ে গেছে। তবে শিগগিরই এটি নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ দিয়ে কোম্পানীর কাজে গতি ফিরিয়ে আনা হবে বলেও তিনি জানান।