বাগেরহাটের শিকদারবাড়ি পূজামণ্ডপ যেন দেব-দেবীর স্বর্গরাজ্য। দেবী দুর্গার সঙ্গী হিসেবে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে এই পূজামণ্ডপজুড়ে। এ পূজামণ্ডপে এবছর দেব-দেবীর ৭০১টি প্রতিমা সাজিয়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে।
হিন্দুপুরাণ মহাভারত এবং রামায়ণের কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিমার মাধ্যমে। কারিগরদের নিপুন হাতের ছোয়া আর রঙ তুলিতে দেব-দেবীর প্রতিমা এমন ভাবে সাজানো হয়েছে দেখলে মনে হয় জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। যেন দেব-দেবীরা কখনো যুদ্ধাং দেহি আবার কখনো শান্তির বাণী ছড়াচ্ছেন। এসব দেব-দেবীর দর্শন আর আরাধনা করতে এরিমধ্যে ভক্তকুল আসতে শুরু করেছে ওই পূজামণ্ডপে।
দুর্গাপূজা এখানে রীতিমতো উৎসবে পরিণত হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে দেশের সর্বত্রই উৎসবের আমেজ।
প্রতিবছর দুর্গোৎসবে শিকদারবাড়ি পূজামণ্ডপে ব্যতিক্রম আয়োজন থাকে। দর্শনার্থীদের আকৃষ্টি করতে সাজসজ্জা আর আলোকসজ্জায় নানা বৈচিত্র আনা হয়। গত বছর এখানে বিভিন্ন দেব-দেবীর ৬৫১টি প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিলো। এবছর প্রতিমার সংখ্যা আরো ৫০টি বাড়িয়ে ৭০১টি করা হয়েছে। আট বছর ধরে চলতে থাকা শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপে প্রতিবছরই প্রতিমার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। জাতী ধর্ম নির্বিশেষে দেশি-বিদেশী দর্শনার্থীদের ঢল নামে এই পূজামন্ডপে।
এবছর দেবী দুর্গা কৈলাস থেকে ঘোড়ায় চড়ে মর্ত্যলোকে বাবার বাড়িতে আসছেন। সোমবার মহাষষ্ঠী পূজার মধ্যে দিয়ে মা দুর্গাকে আরাধনা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার মহাসপ্তমী, বুধবার মহাঅষ্টমী, বৃহস্পতিবার মহানবমী এবং শুক্রবার দশমী পূজা অন্তে দর্পণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গা দোলায় চড়ে কৈলাসে ফিরে যাবেন।
আয়োজকদের দাবি পারিবারিকভাবে পূজামন্ডপে ৭০১টি প্রতিমা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়নি। এবং এটাই বিশ্বের সর্বাধিক দেব-দেবী নিয়ে পূজার আয়োজন। আগামীতেও নানাবৈচিত্র আর প্রতিমার সংখ্যা বাড়িয়ে দুর্গোৎসবের আয়োজন অব্যহত থাকবে এমন আশার কথা শুনালেন তারা।
জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতাদের দাবি, হাকিমপুর শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপে পৃথিবীর সেরা দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। পারিবারিক ভাবে শারদীয় দুর্গোৎসবের এই আয়োজন গ্রিনিজবুকে স্থান পেতে পারে এমন প্রত্যাশা পূজা উৎযাপন পরিষদের নেতাদের।
শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপে গিয়ে দেখা গেছে, মন্দিরের আদলে তৈরি করা হয়েছে বিশাল পূজাপ্যান্ডেল। প্যান্ডেলে আলাদা আলাদা ভাবে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মা দুর্গার মুলমন্ডপের সঙ্গে কয়েকটি সারিতে যুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা। দেখলে মনে হবে পুরো পুজাপ্যান্ডেল যেন দেবালয়। বিভিন্ন দেব-দেবী, মা দুর্গার সঙ্গি হয়ে ধরাধামে এসেছেন এক সাথে। মহিষাসুরকে যে ভাবে বধ করেছিলেন, দেবী দুর্গা তা’ দেখানো হয়েছে প্রতিমার মাধ্যমে। দুষ্টেরদমন আর সৃষ্টিরপালনও তুলে ধরা হয়েছে দেব-দেবীর প্রতিমায়। কারিগড়ররা (ভাস্কর) তাঁদের হাতের নিপুন ছোয়া আর রং তুলিতে অপরূপ সাজে প্রতিমা সাজিয়েছেন।
বিশাল ওই পূজাপ্যান্ডেল ঘুরে দেখা গেছে, ঘোড়ায় চড়ে দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমন, নারায়ণের অনন্ত শয্যা, বিশ্বদেবের সরশয্যা। কুম্ভু অবতার, মৎস্য অবতার, রামচন্দ্রের অকালবোধন, সীতাকে হরণ, রামচন্দ্রের রাবন বদ, মহিনাথ পর্বত, অষ্টশখীর জলকেলি, অভিমুন্নবদ, শ্রীকৃষ্ণের ভক্তপূজা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, একমূতিতে শিব এবং মা দুর্গা, সীতার জন্ম, হরপর্বতী, পঞ্চপান্ডবের বনবাস এবং দোলায় চড়ে দুর্গার গমনসহ নানা বিষয় প্রতিমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এমনকি লালন ফকির এবং টেলিফোনের আবিস্কারক আলেকজেন্ডারকে দেখানো হয়েছে প্রতিমার মাধ্যমে। পূজা প্যান্ডেলের পাশে পুকুরে ৪৫ ফুট উচু লক্ষী ও নারায়ণের স্থাপন করা হয়েছে।
কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে পূজামন্ডপে। মেটাল ডিটেক্টকর দিয়ে তল্লাশী করে দর্শনার্থীদের পূজাপ্যান্ডেলে প্রবেশ করানো হচ্ছে। প্যান্ডলের ভিতরে এবং বাইরে বেশকয়েকটি সিসি টিভি বসানো হয়েছে। সোমবার থেকে দর্শনার্থীরা সেখানে আসতে শুরু করেছেন।
শিল্পপতি লিটন শিকদার ব্যক্তিগত অর্থায়নে এর আয়োজন করে থাকেন।
শিকদারবাড়ি দুর্গাপূজার আয়োজক লিটন শিকদার জানান, সনাতনধর্ম সম্পর্কে সমাজকে জাগ্রত করা এবং গোটা বিশ্বকে সনাতন ধর্মের দেব-দেবীর পূজার মহত্ব জানানোর জন্য শারদীয় দুর্গোৎসবে তার এই আয়োজন। দুর্গোৎসব চলাকালে নায়ক-নায়িকা এবং বিভিন্ন শিল্পিরা পূজাপ্যান্ডেলে আসবেন বলে তিনি জানান।
লিটন শিকদার দাবি করে বলেন, পৃথিবীর কোথাও এক পূজামন্ডপে বিভিন্ন দেব-দেবীর ৭০১টি প্রতিমা সাজিয়ের দুর্গোৎসব হচ্ছে না।
প্রতিমার কারিগড়র (ভাস্কর) বিজয় কৃষ্ণ বাছাড় জানান, ওই পূজামন্ডপে প্রতিমার মাধ্যমে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলিযুগের বিভন্ন দেব-দেবীকে দেখানো হয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে ১৫ জন সহকারীকে নিয়ে দেব-দেবীর ৭০১টি প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অমিত রায়ের দাবি, শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপে পৃথিবীর সেরা দুর্গোৎসবের আয়োজন। শিকাদারবাড়ির ওই পূজার আয়োজন গ্রিনিজবুকের রেকর্ডে স্থান পাওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান,শারদীয় দুর্গোৎসব যাতে শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপকে ঘিরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় জানান, বাগেরহাট জেলায় ৯টি উপজেলার এবছর ৬২২টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পূজামন্ডপগুলোতে কয়েক স্তরের নিরাত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাত হাজার আনসার সদস্য এবং এক হাজার পুলিশ সদস্য পূজামন্ডপগুলোতে নিরাপত্তার কাজে নিয়েজিত রয়েছে। এছাড়া গ্রামপুলিশ এবং পূজাকমিটির সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরাও সার্বক্ষনিক দ্বায়িত্ব পালন করছে। শিকদারবাড়ি পূজামন্ডপে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাট রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী অখিলেশানন্দ মহারাজ জানান, পূজাঅর্চনার মধ্যে দিয়ে মানুষ ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। মানুষ ধর্মীয় অবক্ষয় এবং অশান্তি দুর করার জন্য দুর্গোৎসবে মেতে উঠে। উৎসব বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে একত্রিত করার প্রয়াস।