যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় বেশি মনোযোগী সরকার। তাই সুন্দরবন সংলগ্ন জেলার মানুষকে সচেতন ও বাঘ রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে দুই বছর ধরে ঢাকার বাইরে জাতীয় ভাবে পালন করা হচ্ছে ‘বাঘ দিবস’।
দেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন। কয়েক বছর আগেও চোরাশিকারীচক্র এবং জলদস্যু-বনদস্যুদের তৎপরতার কারণে সুন্দরবনে বাঘ হুমকির মুখে ছিল। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপে সুন্দরবনে দস্যুতা এবং চোরাশিকারীদের তৎপরতা কমেছে। এ কারণে সুন্দরবনে আগের তুলনায় বাঘ অনেকটা সুরক্ষিত এবং বাঘের বিচরণক্ষেত্রও নিরাপদ বলে মনে করছে বন বিভাগ। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এমন আশা বিশেষজ্ঞ ও বন বিভাগ কর্তৃপক্ষের।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের দস্যুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে কোনো সময়ের চেয়ে সুন্দরবনে দস্যুতা কমে গেছে। বন বিভাগ এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে সুন্দরবনে চোরাশিকারীদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। ফলে সুন্দরবনে বাঘ অনেকটা সুরক্ষিত। গত দুই বছরে সুন্দরবনে শিকারীদের হাতে কোনো বাঘ হত্যার খবর পাওয়া যায়নি।
বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির জানান, কিছুদিন আগেও বিশ্বের ১৩টি দেশে বাঘ ছিল। কম্বোডিয়ায় বাঘ শূন্য হওয়ার কারণে এখন বাংলাদেশসহ ১২টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব টিকে আছে। সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের জন্য যে সব ঝুঁকি আছে তা নিয়ন্ত্রণে আছে।
তিনি বলেন, বাঘ শিকার রোধে মনিটরিং করা হচ্ছে। সুন্দরবনে বাঘ শিকার বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থা ধরে রাখতে পারলে সিডর বা আইলার মতো প্রাকৃতিক এবং পরিবেশগত কোনো বিপর্যয় না ঘটলে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়বে। তবে তিনি সুন্দরবনে হরিণ শিকার পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করতে হবে এমন কথা জানালেন।
বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে সুন্দরবনে বাঘ টিকে আছে। সারা পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে গেলেও নিরপত্তা অটুট থাকলে সুন্দরবন থেকে বাঘ হারানোর সম্ভাবনা কম।
বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা গেছে, শত বছরে বিশ্বের বনাঞ্চল থেকে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে কমে মাত্র চার হাজারের নিচে দাঁড়িয়েছে। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির তিনটি ইতিমধ্যে বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক বছর আগেও বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশে বাঘ ছিল। সেখান থেকে আরো একটি দেশ বাঘ হারিয়েছে। এখন বাংলাদেশসহ মাত্র ১২টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, ইন্দ্রোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়ায় বাঘের অস্তিত্ব বজায় রয়েছে। ভিয়েতনাম ও লাওসে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বাঘ। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনীজ টাইগার, জাভানীজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিশ্ব হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচটি উপ-প্রজাতি কোন রকম টিকে আছে। সে গুলো হচ্ছে, বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার।
সারা বিশ্বের বন উজাড়, শিকারী ও পাচারকারীদের কারণে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহিৃত হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বাড়তে পারে এমন আশার কথা সু-সংবাদ হয়ে এসেছে। সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার ও আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করছে।
ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, সারা পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে গেলেও সুন্দরবন থেকে বাঘ হারানোর সম্ভাবনা কম। নদ-নদী বেষ্টিত সুন্দরবন। বাঘ না বাঁচলে সুন্দরবন টিকবে না। সুন্দরবন মায়ের মতো। বাঘের সঙ্গে দেশের সুনাম জড়িয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, বাঘের খাবার টিকিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সুন্দরবনে হরিণ সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি বনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার কথাও ভাবতে হবে। বনের মধ্যে মানুষের বিচরণ কমাতে হবে। পর্যটকদের জন্য বনকেন্দ্রিক তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলার কথা জানান তিনি।
প্রফেসর ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পূর্ণবয়ষ্ক বাঘিনী বছরে তিন থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। বাঘের ওই বাচ্চা রক্ষা করা গেলে অবশ্যই সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বাঘ রক্ষায় সকলকে সম্পৃক্ত করার কথা জানালেন ওই শিক্ষক।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান জানান, প্রথম বার (২০১৩-২০১৫ সালে )সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের জন্য পাঁচ বর্গ কিলোমিটার অন্তর ক্যামেরা স্থাপন করে চিত্র ধারণ করা হয়েছিল। এবার (২০১৭ এবং ২০১৮ সালে) প্রতি দুই বর্গ কিলোমিটার অন্তর ক্যামেরা স্থাপন করে চিত্র ধারণ করা হয়েছে। ধারণকৃত ওই চিত্র এখন ঢাকায় সফটয়ারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশেও সে দেশে ক্যামেরা ট্রাপিং করেছে। বিশ্লেষণ শেষে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের গোটা সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা জানা যাবে।
সূত্র জানায়, ২০১৩-২০১৫ সালে সুন্দরবনে প্রথম পরিচালিত ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের’ মাধ্যমে জরীপ অনুসারে সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে তখন বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি।
বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমান চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনে প্রতিটি বাঘ তাদের আবাসস্থলের জন্য ১৪ থেকে ১৬ বর্গ কিলোমিটার (হোমরেঞ্জ) চিহিৃত করে সেখানে বাস করে। আর গোটা সুন্দরবন জুড়েই রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করে থাকে। বলা হয়, বাঘ সুন্দরবনের ফ্লাগশিপ ইস্পশীজ হিসাবে কাজ করছে। সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যু এবং চোরাশিকারীদের তৎপরতা কম শুধু বাঘের কারণে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবনও হুমকির মধ্যে পড়বে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির কারণে লবণাক্ততা, ঝড়-জলোচ্ছাস এবং নদীর স্রোত প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করছে বাঘ। নদী-খাল ভারাট হওয়ার কারণে বাঘ মাঝে মধ্যে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
সর্বশে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি সুন্দরবন থেকে একটি বাঘ বাগেরহাটের মোড়েলঘঞ্জের গুলিশাখালী গ্রামে ঢুকে পড়ায় বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে। অবশ্য সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামবাসীর মধ্যে সব সময়ই বাঘ আতংক কাজ করে।
সূত্র জানায়, সরকার ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে। নতুন আইন অনুযায়ী বাঘ হত্যা ও পাচার করলে প্রথম বারের জন্য দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয় বার বাঘ হত্যা বা পাচার করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আবার বন বিভাগ থেকে পাশ নিয়ে সুন্দরবন থেকে বনজসম্পদ আহরণ করতে গিয়ে কেউ বাঘের হামলায় নিহত বা আহত হলে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার।
সুন্দরবন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরে এ পর্যন্ত সুন্দরবনে ৩৬টি বাঘের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে দুস্কৃতিকারীদের হাতে ১০টি, লোকালয়ে ঢুকে পড়লে জনতার হাতে ১৪টি, বাধ্যকজনিত কারণে ১০টি এবং ২০০৭ সালে সিডরে একটি বাঘ মারা গেছে। আর চলতি বছরে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় স্থানীয়দের পিটুনিতে একটি বাঘ মারা যায়। এই সময়ে বাঘের পাল্টা আক্রমনে প্রায় ৩০০ জন জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল এবং গ্রামবাসী মারা গেছে। তবে ২০১৬ সাল থেকে চলতি ২০১৮ সালের এ পর্যন্ত দুস্কৃতিকারীদের হাতে সুন্দরবনে বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেনি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘ ১৩২ বার সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। বাঘ গ্রামবাসীর ওপর যেমন আক্রমন করেছে, তেমনি পাল্টা বাঘের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। বাঘে-মানুষে লড়াইয়ের ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। ১০ বছরে বাঘের হামলায় জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল এবং গ্রামবাসী মিলে ১৮৪ জন মারা গেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো.বশিরুল-আল-মামুন জানান, এই অংশ দিয়ে বাঘ শিকারীচক্রের সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ কম। বাঘ সুন্দরবনের গহীনে ভাল আছে।
সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি এবং বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, সুন্দরবন ঘেষা কয়েকটি গ্রামে এক সময় একাধিক বাঘ শিকারীচক্র সক্রিয় ছিল। কয়েক বছর আগেও শিকারীচক্র এবং দস্যুরা গুলি করে, বিষটোপ দিয়ে এবং ফাঁদ পেতে বাঘ হত্যা করেছে। এখন ওই সব গ্রামে আর শিকারীচক্রের তৎপরতা নেই।
তিনি বলেন, মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সুন্দরবন এবং বনের সম্পদ সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। সুন্দরবনকে মানুষ ভালবাসতে শিখেছে। সর্বোপরি সুন্দরবন সংলগ্ন অনেক মানুষ কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়ায় বনে প্রবেশের প্রবণতা কমে গেছে। এসব কারণে এখন সুন্দরবনে বাঘ হত্যা নেই বলে তিনি জানান।