জানা গেছে, মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে ওইসব জেলার চরাঞ্চলের কৃষকদের। বর্ষা মৌসুমে তুলনামুলক বৃষ্টিপাত না থাকা এমনকি গেল বছর ওই অঞ্চলে বন্যা না হওয়াকেও দায়ী করছেন তারা।
কৃষকরা জানায়, বন্যা তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে এলেও চাষাবাদে মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটিতে রস সৃষ্টি হয়। এতে ফলনও আশারূপ হয়। কিন্তু গেল বর্ষা মৌসুমে বন্যা তো নেই-ই এমনকি বৃষ্টিও হয়েছে খুবই কম। জলবায়ুর প্রভাবে এমনটি হচ্ছে। আর তাই ওইসব অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ মেয়াদী খরার কবলে পড়ার আশংকা কৃষক ও বিশেষজ্ঞদের।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর যাত্রাপুরের কৃষক আব্দুল লতিফ (৬০) চরের জমিতে ধান, বাদাম, মাসকালাইসহ তিন বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন। তিনি জানান, চলতি শুষ্ক মৌসুমে মাটি শুকনা থাকায় খরচ বেশি পড়েছে। ফলনও তেমন একটা হয়নি।
একই এলাকার কৃষক বক্কর (৬৫), সোবহান আলী (৫৫) জানান, এবার যে তাপের অবস্থা তাতে চরাঞ্চলে আবাদ করা নিয়েই সংশয় রয়েছি। মাঘ মাসেই নদ-নদীর পানি কমে গেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে যে কি অবস্থা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
তারা বলেন, বিগত বছরগুলোতে বাদাম চাষে বিঘা প্রতি ৫/৬হাজার টাকা খরচ করে ফলন উঠতো ১২/১৪মণ। কিন্তু এবারও একই খরচ করে বাদাম পাওয়া যাচ্ছে ৭/৮ মণ। ধার-দেনা করে অনেকেই চাষ করে এখন লোকসানের মুখ পড়তে হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে নদ-নদীসহ জীববৈচিত্র্যে এর প্রভাব পড়ছে। জেলাকে বড় ধরনের খরার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার ইতোমধ্যে নদ-নদী খনন কাজের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে পানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে নদী বিধৌত জেলা কুড়িগ্রাম। ব্রহ্মপুত্রসহ, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদী রয়েছে এ জেলায়। আর এসব নদ-নদীর ৩১৬ কি.মি. দৈর্ঘ্য পথে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক ছোট-বড় চর-দ্বীপ জেগে উঠেছে। এসব চরাঞ্চলে প্রায় ৪/৫ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। কৃষির উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয় এই জনপদের মানুষদের। শীত-বর্ষা, খরা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে জীবন সংগ্রামে বাঁচতে হয় চরাঞ্চলের কৃষকদের।
সূত্র আরও জানায়, গত বর্ষা মৌসুমে উল্লেখযোগ্য বন্যা আর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে চরাঞ্চলের কৃষকদের পড়তে হয়েছে আগাম খরার মুখে। নদ-নদী গুলোর তলদেশ ভরাট আর পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাওয়ায় মাটির রস শুকিয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের খরার মুখে পড়ার আংশকা জেলার কৃষকদের।
কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়াম্যান আব্দুর রহিম রিপন জানান, যাত্রাপুর ইউনিয়নটি দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা বেষ্টিত। এবছর নদ-নদীর পানি কমে যাওয়া মাটিতে রস নেই। ফলে সেচ দিয়ে আবাদ করতে গিয়ে গুণতে হচ্ছে কৃষককে বাড়তি খরচ। তাপমাত্রা বেশি থাকায় চরের ফলনও কমে এসেছে। ফলে ধার-দেনা করে আবাদ করলেও লোকসানের মুখে পড়েছেন এখানকার কৃষক।
জেলা কৃষি অধিদপ্তর জানায়, জেলার মোট আবাদি জমি এক লাখ ৬১ হাজার ৮৭৩ হেক্টরের মধ্যে চরাঞ্চলে জমি রয়েছে ৫৫ হাজার ৪০৮ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদ হয় ৩৪ হাজার ৯০১ হেক্টরে। চরাঞ্চলের জমিতে প্রতিবছরই ধান, বাদাম, কাউন, সরিষা, চিনা, তিল, তিশি, মাসকালাই, তরমুজ, মিস্টিকুমড়া, আলু বাঙ্গিসহ হরেক রকম ফসল উৎপাদন করে থাকে সেখানকার কৃষকরা।
কুড়িগ্রাম আবহাওয়া অফিসের আবহওয়া পরিদর্শক এএইচএম মোফাখখারুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, চলতি শুষ্ক মৌসুম জুন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তাপমাত্রা এবার ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবারও পূর্বাভাস দেন তিনি ।
এই আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, তবে এ বছর কালবৈশাখী ঝড়ের সময় অধিক বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হবার আশংকা রয়েছে। গত বছরের মে মাসে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কুড়িগ্রামে রেকর্ড করা হয় ৩৯ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, বন্যা আর বৃষ্টিপাত না থাকায় কৃষককে ফলন উৎপাদনে ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় কুড়িগ্রামের আবাদি জমিতে পানি ধরে রাখার ধারণক্ষমতা কম থাকাকেও খরার জন্য দায়ী বলে মনে করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন খরার কথা স্বীকার করে জানান, জেলার নদ-নদীতে পানি না থাকায় চরাঞ্চলের কৃষকসহ অনেক কৃষকই ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনাসহ চরাঞ্চলের কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বার দেন তিনি।