ঝড়ো বাতাসের গতিবেগ এবং নিকটবর্তীতা বোঝানোর জন্য সতর্কতা হিসেবে জারি করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত। যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতির তাগিদে গণমাধ্যম জুড়ে প্রচারিত এই সংকেতগুলো ঝড়ের সর্বশেষ অবস্থার ব্যাপারে জানান দেয়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হিসেবে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে থাকে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো। জরুরি বিপদ সংকেতগুলো অনুসরণ করে আগাম প্রস্তুতি অবলম্বনে দুর্যোগকালীন ক্ষয়-ক্ষতি অনেকটা কমে আসে। তাই চলুন, সমুদ্র পাড়ের জনসাধারণের নিরাপত্তায় ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেতগুলোর মানে জেনে নেওয়া যাক।
সমুদ্র বন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড়ের ১১টি সতর্ক সংকেত
১. নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত
এর মানে উপকূল থেকে দূরবর্তী কোনও অঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া বিরাজ করছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টা প্রতি সর্বোচ্চ ৬১ কিলোমিটার, যা আকস্মিক সামুদ্রিক ঝড়ের পরিণত হতে পারে। অর্থাৎ জাহাজ বা বড় নৌকা ছেড়ে গেলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২. নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত
১ নং সংকেতের মত এটি উপকূল থেকে দূরের সামদ্রিক অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য। সাগরের গভীরে সৃষ্ট ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। এতে তাৎক্ষণিক ভাবে বন্দর ঝড়ে কবলে পড়বে না। তবে কোনও জাহাজ ছেড়ে গেলে মাঝ পথে বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। ট্রলার বা মাছ ধরা নৌকাগুলো উপকূলের কাছাকাছি থেকে চলাচল করা উচিত। এতে করে নৌকাগুলো যে কোনও জরুরি অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ে দ্রুত পৌছে যেতে পারবে।
আরও পড়ুন: কিভাবে নেবেন ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি
৩. নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত
এর মানে ঘূর্ণি বাতাস একটানা ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাবে। এটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কা, যার ফলে বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর আশঙ্কা রয়েছে দুর্যোগের কবলে পড়ার। মাঝ সাগরে চলাচলরত অনুর্ধ্ব ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের নৌযানগুলোকে অনতিবিলম্বে তীরে ফিরতে হবে।
৪. নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত
বন্দর ইতোমধ্যেই ঘণ্টায় ৫১ থেকে ৬১ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়ে কবলিত। তবে এ সময়টি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া মত বিপজ্জনক নয়। সাগরের গভীরে ভেসে চলা ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের নৌযানগুলোর যথা শিঘ্রই সম্ভব বন্দরে ফিরে আসা উচিত। এ অবস্থায় স্থানীয়দের সতর্কীকরণে একটি সংকেত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পাশাপাশি মাইক ও মেগাফোনের মাধ্যমে উচ্চস্বরে স্থানীয়দের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
৫. নম্বর বিপদ সংকেত
এই সময় ঘূর্ণিঝড় সৈকতকে বামে রেখে উপকূল অতিক্রম করে যায়। ঝড়ো বাতাসের এই যাত্রায় একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে সর্বোচ্চ ৮৮ কিলোমিটার-এ উঠতে পারে। ফলে ছোট বা মাঝারি তীব্র সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়তে পারে উপকূল এলাকা। এই সময় থেকে শুরু হয় দুইটি সংকেত পতাকা উত্তোলন করা। এছাড়া মাইক, মেগাফোন ও পাবলিক এড্রেস সিষ্টেম ব্যবহার করে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করা হয়।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কেন, কীভাবে, কারা করেন
৬. নম্বর বিপদ সংকেত
এ ক্ষেত্রেও ৫ নম্বর সংকেতের মত ঝড়ো হাওয়া গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। এই একটানা বেগে গোটা উপকূল অঞ্চল ছোট বা মাঝারি তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে নিপতিত হবে। তবে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের উপর দিয়ে যাবে সৈকতকে ডানে রেখে। স্বভাবতই এখানে ঝড়ো হাওয়ার ধাক্কাটা বেশি প্রতীয়মান হবে। এ অবস্থায় কোনও নৌযান সাগরে যেতে পারবে না। আর সাবধান বাণীর প্রচারণা হবে দুইটি পতাকার মাধ্যমে। ঝড়ের ব্যাপারে স্থানীয়দের অবহিত করতে আরও ব্যবহৃত হবে মাইক, মেগাফোন ও পাবলিক এড্রেস সিষ্টেম।
৭. নম্বর বিপদ সংকেত
এই সময়েও ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার বেগে মাঝারি বা ছোট তীব্রতার ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে সৈকত। তবে ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় ঝড়ো হাওয়ার ধাক্কা সৈকতসহ এর আশেপাশের উপকূল এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। এখানেও সতর্কতাস্বরূপ প্রদর্শিত হবে দুইটি পতাকা এবং করা হবে মাইক, মেগাফোন এবং পাবলিক এড্রেস সিষ্টেম।
৮. নম্বর মহাবিপদ সংকেত
সৈকতের উপর দিয়ে অতিক্রম করা এবারের ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা সর্বোচ্চ। এখানে ঘূর্ণি বাতাসের অবিরাম গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তারও বেশি। ঝড়টি এই তীব্রতা অব্যাহত রেখেই সৈকত বামে রেখে উপকূল অতিক্রম করে যাবে। এ অবস্থায় স্থানীয় অধিবাসী এবং কোনও নৌযান নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে যেতে পারবে না। এই সময় থেকে শুরু হবে ৩টি পতাকা উত্তোলন। আর মেগাফোন, মাইক, ও পাবলিক এড্রেস সিষ্টেমের পাশাপাশি আরও ব্যবহার করা হবে হ্যান্ড সাইরেন।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: ভোলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, পানিবন্দি ২০ হাজার মানুষ
৯. নম্বর মহাবিপদ সংকেত
এখানে সমগ্র উপকূল সর্বোচ্চ তীব্রতর মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হবে। অবিরাম ঝড়ো হাওয়ার সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভয়াবহ ঝড়টি সৈকতকে ডান দিকে রেখে উপকূলের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। এ সময় কোনও অবস্থাতেই নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করা সমীচীন নয়। এখানে তিনটি পতাকা প্রদর্শনের পাশাপাশি মেগাফোন, মাইক, পাবলিক এড্রেস সিষ্টেম, এবং হ্যান্ড সাইরেন বাজিয়ে সাবধানতার তাগিদ দেওয়া হয়।
১০. নম্বর মহাবিপদ সংকেত
ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগের ঝড়ো হাওয়ায় এক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পরিস্থিতি বিরাজ করবে গোটা উপকূল জুড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ক্রমশ সুপার সাইক্লোনে রূপ নিতে শুরু করবে। এ অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার কোনও বিকল্প নেই। এখানেও সতর্কীকরণে তিনটি পতাকা প্রদর্শন করা হয়। আর একই ভাবে মেগাফোন, মাইক, পাবলিক এড্রেস সিষ্টেম ও হ্যান্ড সাইরেন বাজিয়ে স্থানীয়দের জানান দেওয়া হয়।
১১. নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত
এটি বিপদসীমার সর্বোচ্চ অবস্থান, যেখানে বিপদ সংকেত প্রদানের কোনও অবকাশ থাকে না। সংকেত প্রচারকারীদের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পরিশিষ্ট
ঘণ্টাপ্রতি ৬১ কিলোমিটার বেগের বাতাস সর্বনিম্ন মাত্রার সতর্কতা নির্দেশ করে। এরপর থেকে গতিবেগ বাড়তে বাড়তে ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার ছাড়ানো মানে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা আশঙ্কাজনক মাত্রায় পৌছা। চরম সীমায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেতের মাধ্যমে জারি করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ সতর্ক সংকেত। এখানে সর্বোচ্চ ৬ নম্বর বিপদ সংকেত পর্যন্ত নিরাপদ স্থানে সরে পড়ার অবকাশ থাকে। এরেউপরে বিশেষত ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর সংকেত মানেই ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন। তাই পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয় কোনও ভাবেই ত্যাগ করা উচিত নয়।
আরও পড়ুন: বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেই যেসব খাবার সংরক্ষণ করা জরুরি