গত দশক জুড়ে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কারণে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ব্যাপারটি এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া চলমান করোনাভাইরাস মহামারির দরুণ দেশবাসী প্রচন্ড বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সেই ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দিতেই যেন বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত উত্তর আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি। এখানে সৃষ্ট নিম্নচাপ ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ২৪ মে-এর মধ্যে প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অতঃপর উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ২৬মে বাংলাদেশের খুলনা উপকূলে পৌছতে পারে বলে জানিয়েছে আবাহাওয়া অধিদপ্তর।
এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি যেন কম হয়, সেজন্যে আগে থেকেই যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে, চলুন জেনে নেই।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পূর্ব প্রস্তুতি
গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। ঘর তৈরির সময় খেয়াল রাখুন যেন তা মাটি থেকে যথাসম্ভব উচু স্থানে হয়। মজবুত ভিত্তির ওপর লোহার বা কাঠের পিলার এবং ফ্রেম দিন। অতঃপর তা ছাউনি দিয়ে ঢেকে দিন। ছাউনিতে টিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হউন কারণ ঝড়ের সময় টিন উড়ে মানুষ ও গবাদিপশু আহত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ০.৫ মিলিমিটার পুরুত্ববিশিষ্ট টিন ও জেহুক ব্যবহার করতে পারেন।
২। ঝড়ের কথা মাথায় রেখেই বাড়ির আঙ্গিনায় নারকেল, কলা, বাঁশ, তাল, কড়ইসহ অন্যান্য শক্ত গাছপালা লাগান।
৩। জেলে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলারসহ সকল জলযানগুলোতে রেডিও রাখুন। নদী বা সাগরে থাকার পুরোটা সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার অভ্যাস করুন।
৪। ঘূর্ণিঝড়ের সিজনে বাড়িতে কয়েক দিন মজুদ করে রাখা যায় এরকম শুকনো খাবার যেমন মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট ইত্যাদি রাখবেন।
৫। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কোন এলাকার লোক কোন আশ্রয়ে যাবে, গবাদিপশু কোথায় থাকবে, সব কিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখুন। কাছে এবং দূরে যথা সম্ভব সব সুরক্ষিত জায়গাগুলো সবাই আগেই চিনে রাখুন। করোনার কারণে সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারটা এ সময় ভুলে যাবেন না। আশ্রয় দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোরও খেয়াল রাখতে হবে যেনো, প্রতিটি আশ্রয়স্থলে যথেষ্ঠ দূরত্ব বজায় রেখে লোক সমাগম হয়।
৬। সম্ভব হলে সব সময় কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন ব্যান্ডেজ, ডেটল প্রভৃতি সাথে রাখুন।
৭। আশ্রয়কেন্দ্রে বা অন্য আশ্রয়ে যাওয়ার সময় কী কী জিনিস সঙ্গে নিবেন আর কী কী জিনিস মাটিতে পুঁতে রাখবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যেমন—চাল, ডাল, দেশলাই, শুকনো কাঠ, পানি ফিটকিরি, চিনি, নিয়মিত ব্যবহৃত ওষুধ, বইপত্র, ব্যান্ডেজ, তুলা, ওরস্যালাইন, দলিলপত্র, টাকা-পয়সা ইত্যাদি পানি নিরোধক পলিথিন ব্যাগে ভরে মাটিতে পুঁতে রেখে যেতে পারেন।
৮। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর সাথে সাথেই আপনার ঘরগুলোর অবস্থা একবার পরীক্ষা করে নিন। আরো মজবুত করার জন্য মাটিতে খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘরের বিভিন্ন অংশ বেঁধে রাখতে পারেন।
৯। পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে সিপিপির (সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম) স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
১০। বাড়ি ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই আগুন নিভিয়ে যাবেন।
১১। টিউবওয়েলের মাথা খুলে নিন। অতঃপর সেই খোলা অংশ পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে আটকে রাখুন যাতে টিউবওয়েলের মধ্যে ময়লা ঢুকতে পারবে না।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড় রিমাল: জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত সুন্দরবন
১২। বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ ও খাওয়ার উপযোগী। তাই ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখুন। মাটির বড় হাঁড়িতে বা ড্রামে পানি রেখে তার মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে দিন, যেন পোকা-মাকড় বা ময়লা-আবর্জনা ঢুকতে না পারে।
শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে
১। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি ও রেডিও তে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থেকে নির্দেশনা শুনুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন।
২। আপনার পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার লাইট, টর্চ লাইট ফুল চার্জ দিয়ে নিন। মোমবাতি এবং লাইটার সাথে রাখুন।
৩। আপনার বাসা যদি টিন শেড হয় বা আপনি যদি নিচ তলায় থাকেন তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পানিরোধক বাক্সে টেপ এবং পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে রাখুন। মেঝেতে অবশ্যই মাল্টিপ্লাগ রাখবেন না।
৪। নিরাপত্তার জন্য শহর জুড়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকতে পারে। রাস্তা বন্ধ থাকতে পারে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার সংগ্রহে রাখুন।
৫। রেলিংয়ের ওপর ফুলের টব, সানশেডে থাকা এসির বাইরের যন্ত্র, কনস্ট্রাকশন এর জিনিস নিরাপদ স্থানে রাখুন। আপনার বাসার পাশে নির্মাণাধীন ভবন থাকলে আপনাকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।