হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের স্বাক্ষরের পর ১৯২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় বুধবার প্রকাশিত হয়।
২০১১ সালের ২৮ জুন অ্যাডভোকেট যুথী ও তার মেয়েকে টরন্টো যেতে না দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি বিমানবন্দরে নামিয়ে দেয় ইত্তেহাদ এয়ার লাইন্স। এ ঘটনায় তানজিন বৃষ্টির করা এক রিট আবেদনে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতবছর ৮ অক্টোবর এ রায় দেন হাইকোর্ট। যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো আজ।
আরও পড়ুন: ডিএজি ও এএজি নিয়োগের বৈধতা প্রশ্নের রুল শুনানিতে বিব্রত হাইকোর্ট
শুনানিতে রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, অ্যাডভোকেট রিপন বাড়ৈ ও অ্যাডভোকেট সঞ্জয় মন্ডল। ইত্তেহাদের কান্ট্রি ম্যনেজারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও মো. আজিজ উল্লাহ ইমন।
রায়ে বলা হয়েছে, দুই যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক, অসদাচরণ করেছে। এই হয়রানি ও নির্যাতন অর্থদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। তারপরও প্রতিকী হিসেবে অর্থদণ্ড করা হলো। রায়ে ভবিষ্যতে নারী যাত্রীদের সঙ্গে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে এবং সম্মানজনক আচরণ করতে ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে জেন্ডার বা শরীরের রং বিবেচনায় যেন আর কোনো যাত্রীর সঙ্গে এরকম আচরণ করা না হয়।
আবুধাবি বিমান বন্দরে ২০১১ সালের ২৮ জুন হয়রানী/নির্যাতন/আটকের শিকার হন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথী এবং তার মেয়ে তানজিন বৃষ্টি। অ্যাডভোকেট যুথী বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের সহধর্মিনী। তাদের কানাডা যেতে না দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ ঘটনায় তারা দেশে ফিরে ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট আবেদন করেন।
এ রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ১৪ জুলাই রুল জারি করেন। পাশাপাশি ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্স এর কান্ট্রি ম্যানেজারকে তলব করেন। এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘটনা তদন্ত করে একটি রিপোর্ট দাখিল করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে যে ৫ দফা নির্দশনা দেয়া হয়েছে তা হলো-
১. বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ সংকটজনিত কারণে ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজের অবস্থা বিবেচনায় আবেদনকারী এবং তার মা প্রত্যেককে মাত্র ১ (এক) কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ এর বাংলাদেশ প্রতিনিধির মাধ্যমে ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজকে নির্দেশ দেয়া হলো।
২. এ রায় ও আদেশের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তি মাস হতে ২০টি (বিশ) সমান মাসিক কিস্তিতে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হবে।
৩. নারী যাত্রীদের সঙ্গে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতে হবে।
৪. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশি নাগরিকরা আকাশ পথে চলাচল করেন। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের পণ্য প্রতিনিয়তই আকাশ পথে পরিবহন করা হয়। তাই বাংলাদেশি প্রবাসী সকল কর্মজীবী ও রপ্তানিকারদের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং তাদের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের সকল দূতাবাসে এ মামলার রায় অনুসারে সভা, সেমিনার আয়োজন করে বিমান সংস্থার দায়বদ্ধতার বিষয়ে তাদের ওয়াকিবহাল করতে হবে। যাতে আকাশ পথে যাতায়াতের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ তারা আদায় করতে সক্ষম হন।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়ার জন্মসনদসহ নথিপত্র হাইকোর্টে তলব
৫. বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)-এর কার্যক্রম যতটা যাত্রীবান্ধব, তার চেয়ে বেশি পরিবহন সংস্থা বান্ধব। যেহেতু বর্তমান বিশ্বে যাত্রী এবং পণ্য দ্রুত পরিবহনের অন্যতম তথা প্রধান মাধ্যম আকাশ পথ। সেকারণে আকাশ পরিবহন সংস্থা এবং যাত্রী সাধারণের মধ্যকার দায়-দায়িত্বসমূহ আরও বেশি সহজ সরল, সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। বিশেষ করে সাধারণ যাত্রী এবং সাধারণ পণ্য মালিককে সুরক্ষা প্রদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশাল বিমান সংস্থার সামনে সাধারণ যাত্রী নিতান্তই অসহায়। একারণে আইসিএও-কে আকাশ পথে যাত্রী এবং যাত্রীর লাগেজ, পণ্যের মালিকের অধিকতর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য আরও বেশি তৎপর হতে হবে। আইসিএও’র প্রধান উদ্দেশ্য এবং কাজ হবে সাধারণ যাত্রীরা যেন তার অধিকার আদায়ে কিংবা তার ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনোপ্রকার বাধা বিপত্তির সম্মুখীন না হয় সেটি দেখা। আকাশ পরিবহন কার্যক্রম পরিবহন সংস্থার লাভের জন্য নয়। বরং এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ভ্রমণকারীদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে।