পাওনা আদায়ে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের চাকরিচ্যুত কর্মচারীদের পক্ষে লড়াই করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী শ্রমিকদের কাছ থেকে ১৬ কোটি টাকা ফি নিয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য ফি বাবদ শ্রমিকদের কাছ থেকে আরও ১০ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশে আইনজীবী ইউসুফ আলী এফিডেভিট আকারে মঙ্গলবার বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চে এ তথ্য জানান। পরে শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এই ১৬ কোটি টাকা ইউসুফ আলী আদৌ ‘ফি’ হিসেবে পেয়েছেন কি না এবং ‘অন্যান্য খরচ’ বাবদ আরও ১০ কোটি কে, কী বাবদ পেয়েছেন, বৃহস্পতিবার তা ‘পরিষ্কারভাবে’ হলফনামা আকারে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে ইউসুফ আলীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম, অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু, অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা ও ব্যারিস্টার অনীক আর হক। গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান।
শুনানিতে আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, আইনজীবী ফি নিয়েছেন ১৬ কোটি টাকা। ১০ কোটি টাকা অন্যান্য ফি। তখন আদালত বলেন, এটা সিম্পল ব্যাপার। আপনি বলুন যে আপনি এত টাকা ফি নিয়েছেন। বাকিটা দুদক নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে সেটা তাদের ব্যাপার।
আদালত আরও বলেন, ১০ কোটি টাকার (অন্যান্য ফি বাবদ) বিষয়ে বিস্তারিত বলুন। এত লুকোচুরি কেন? সম্পূর্ণভাবে বলতে হবে নির্দিষ্ট করে। তখন আইনজীবীরা বলেন, তারা সম্পূরক হলফনামার মাধ্যমে সবকিছু নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে দেবেন। এরপর আদালত তাদের দুই দিন সময় দেন।
পরে আহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউসুফ আলী এবং অন্যান্য আইনজীবী যারা ছিলেন, তাদেরকে ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়। আরও ১০ কোটি টাকা ট্রেড ইউনিয়নের একাউন্টে আছে। সুতরাং যে টাকা দেয়া হয়েছে, তা ফি বাবদই দেয়া হয়েছে। আদালতে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এবং ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একই কথা বলা হয়েছে। তারাও বলেছে, এটা শ্রমিকদের ফি বাবদ দেয়া হয়েছে। টেলিকমের কাছ থেকে অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী সাহেব কোনো টাকা গ্রহণ করেননি, তাদের অন্য কোনো অ্যাডভোকেটও গ্রহণ করেননি। তবে ইউসুফ আলী ‘অ্যাডভোকেট ফি’ হিসেবে যে অর্থ নিয়েছেন, এটি আদালত ‘বিষয়বস্তু’ হিসেব দেখছে না বলে দাবি করেন আহসানুল করিম।
তিনি বলেন, ‘কোর্টের মুখ্য বিষয় ছিল এই যে ট্রানজেকশনের স্বচ্ছতা কী, তা দেখার জন্য। ইউসুফ আলী সাহেব কত টাকা নিয়েছেন, এটা পরিষ্কার করেছেন, কোর্টের এটি বিষয়বস্তু না। কোর্ট শুধু দেখতে চেয়েছে, ট্রানজেকশন যেটি হয়েছে এর স্বচ্ছতা কী? এফিডেভিট যেটি ছিল, সেটি কোর্টের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে এটি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত হয়নি। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছে আদালত। সেদিন ইউসুফ আলীকে এ বিষয়ে ‘পরিষ্কারভাবে’ আদালতকে জানাতে হবে। এফিডেভিট আকারে ইউসুফ আলী সাহেবকে বলতে হবে যে, কত টাকা তিনি ফি হিসেবে পেয়েছেন, আদৌ তিনি ফি হিসেবে পেয়েছেন কি না, কত টাকা তিনি গ্রহণ করেছেন। বাদ বাকি টাকা, যেটি ২৬ কোটি টাকার মধ্যে ১০ কোটি টাকা অন্যান্য বাবদ খরচের কথা বলা হয়েছে, এই ১০ কোটি টাকা কে পেল, সেটি পরিষ্কারভাবে বলতে বলা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: গ্রামীণ টেলিকম অবসায়ন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন, আদেশ ৩ এপ্রিল
গত ৩০ জুন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় রিটকারীদের আইনজীবীকে ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে সমঝোতার প্রসঙ্গ তোলেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, আমরা শুনেছি শ্রমিকদের আইনজীবীকে অর্থের বিনিময়ে হাত করে তাদেরকে মামলায় আপস করতে বাধ্য করা হয়েছে। আদালতকে ব্যবহার করে অনিয়ম যেন না হয়ে থাকে। যদি সবকিছু আইন অনুযায়ী না হয় তবে বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখা হবে। শ্রমিকদের আইনজীবী কীভাবে ১২ কোটি টাকা নেন? পরে শ্রমিকরা কে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন সেই তালিকা দাখিল করার নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত নথিও ২ আগস্টের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয়।
সেদিন আইনজীবী ইউসুফ আলী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসকে পরাজিত করে চাকরিচ্যুত কর্মচারীদের ৪৩৭ কোটি টাকা আদায় করে দিয়েছি। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের ফি ক্লায়েন্টরা আমাকে দিয়েছেন। ১২ কোটি টাকার কথা যে বলা হচ্ছে, তা টোটালি একটি ইমাজিনারি ফিগার। তবে আমার ক্লায়েন্টরা বড় অঙ্কের টাকা পেয়েছেন, আমাকে বড় অঙ্কের ফি দিয়েছেন।
২০০৬ সাল থেকে গ্রামীণ টেলিকমের মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তহবিল গঠনসহ লভ্যাংশ শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করার কথা। কিন্তু সেটি না করায় শ্রম আদালতে ১০৪টি ও হাইকোর্টে ছয়টি মামলা করেন কোম্পানিটির শ্রমিক-কর্মচারীরা। গত ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের অবসায়ন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন।
গত ২৩ মে ইউসুফ আলী জানান, সম্প্রতি গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা দাবি নিয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছে। মালিকপক্ষ গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের পাওনা ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছেন। আর তাই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
এরপর ৩০ জুন তিনি সাংবাদিকদের জানান, গ্রামীণ টেলিকম একটি সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট করেছিল, যেটির সিগনেটরি হলেন কোম্পানির এমডি ও ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। ওই অ্যাকাউন্টে পুরো ৪৩৭ কোটি টাকা ট্রান্সফার করা হয়। সেখান থেকে পাওনাদারদের পাওনা হিসাব করে পরিশোধ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: গ্রামীণ টেলিকম নিয়ে দুদকের তদন্ত শুরু