মাত্র চার বছর আগেও চরম অব্যবস্থাপনা আর নোংরা আবর্জনার ভাগাড় ছিল চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। আর্থিক দৈন্যদশায় পশুপাখি ও জীবজন্তুর অভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল এ বিনোদন স্পটটি। আর তাই নগরী ও আশপাশের পর্যটকরাও এ বিনোদন কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল। অথচ শুধুমাত্র দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিটের মূল্য দিয়েই বর্তমানে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় নান্দনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।
পাহাড়বেষ্টিত পরিবেশে আশির দশকে নির্মিত এই বিনোদন কেন্দ্রটিতে এখন প্রতিদিন গড়ে হাজার দর্শনার্থী ভিড় করছেন। বন্ধের দিনে সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চিড়িয়াখানার অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিদেশি সিংহ, বাঘ ও হরিণসহ নানা প্রাণী আনার পাশাপাশি দর্শনার্থীর বিশ্রামের জন্য লাল, সবুজ, নীল, বেগুনি, গোলাপিসহ নানা রঙে ও দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে তৈরি বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে ঔষধি ও ফলজ গাছের সংখ্যা। নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো চিড়িয়াখানাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে। সর্বশেষ ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মিনি এভিয়ারিতে ৬ প্রজাতির ৩৪২টি পাখি সরবারাহ করা হয়। ময়ূর, ধনেশপাখি, শকুন, চিল, নানা প্রজাতির বক ও পেঁচাসহ কিছু পাখির জন্য আলাদা আলাদা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে।
চিড়িয়াখানার গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন নবনির্মিত পক্ষীশালাটি। দর্শনার্থীর পদচারনায় আর নবনির্মিত বিশাল অবকাঠামোই স্বাধীনভাবে পাখিদের বিচরণ এ যেন এক অন্যরকম পরিবেশ।
রঙ-বেরঙের সব পাখি নিয়ে নির্মিত পক্ষীশালাটি দর্শনার্থীদের জন্য বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়। এদিন সকালে প্রথমে ফিতা কেটে ও পাখিদের খাঁচায় অবমুক্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, নতুন আঙ্গিকে সাজাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র দর্শনার্থীদের টাকায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাকে নান্দনিক করে তোলা হচ্ছে। সর্বশেষ সংযোজন পক্ষীশালা নির্মাণ। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর ‘অদল-বদল’ প্রক্রিয়ায় রংপুর চিড়িয়াখানায় একটি সিংহী দিয়ে একটি সিংহ আনা হয়।
২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৩ লাখ টাকা খরচ করে এক জোড়া বাঘ আনা হয়। চলতি বছরের মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি জেব্রা সংগ্রহ করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের পশুপাখি সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও পরিচয় করিয়ে দিতে দর্শকদের টাকায় নানা প্রজাতির পশুপাখি ও জীবজন্তুর সমাহার করা হয়। দর্শানার্থীদের আরও আকর্ষণ করতে শিগগির অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্যাঙ্গারু আর উটপাখি আনার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন।
এছাড়া চিড়িয়াখানার জায়গা বাড়াতে পাহাড় থেকেও কিছু জায়গা নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন।
চিড়িয়াখানা নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব ও হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানিয়েছেন, দর্শনার্থীদের বিভিন্ন পাখি দেখার সুযোগ করে দিতে জেলা প্রশাসকের পরিকল্পনা আর নির্দেশনায় ন্যাচারাল মিনি এভিয়ারিটি তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দৈর্ঘে ৬০ ফুট আর প্রস্থে ২৫ ফুট আয়তনের পক্ষীশালাটি ২০ লাখ টাকা অবকাঠামো ব্যয়ে আর বাকি ১৪ লাখ টাকা ৬ প্রজাতির ৩৪২টি পাখি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে। পাখিদের মধ্যে ২০ জোড়া লাভ বার্ড, ৫০ জোড়া লাফিং ডোব, ১০ জোড়া ফিজন্ট, ১০ জোড়া রিংনেক প্যারট, ৫০ জোড়া ককটিয়েল, এক জোড়া ম্যাকাও রয়েছে। বাকিগুলো বিভিন্ন প্রজাতির।
তিনি আরও বলেন, টিকিট বিক্রির টাকায় এ চিড়িয়াখানার আকর্ষণীয় ফটক নির্মিত হয়েছে। প্রধান এফট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ টাকা। ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে নির্মিত হয়েছে ৩২ হাজার ১৬৪ বর্গফুট সড়ক। শিশুদের জন্য কিডস জোন করা হয়েছে। দর্শনার্থী বসার জন্য বেঞ্চ, শৌচাগার তৈরির পাশাপাশি এক হাজার ফলদ বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে চিড়িয়াখানার চারপাশে সুউচ্চ সীমানা প্রাচীর। দর্শনার্থীদের চলাচলের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে সুপ্রশস্থ সিঁড়ি। জেলা প্রশাসনের সার্বিক নির্দেশনা ও তাদের সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের অবদানে চিড়িয়াখানাটি আজ পূর্ণ্যতা ফিরে পেয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান ফয়েস লেকের পাশে ছয় একর জমিতে বিনোদনের জন্য চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ চিড়িয়াখানায় বর্তমানে বাঘ, সিংহ, হরিণ, কুমির, অজগর, ভাল্লুক, জেব্রা, উটপাখিসহ প্রায় ৬৭ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।