বিগত বছরগুলোর প্রচেষ্টা এবং সফলতার ভিত্তিতে এ বছর ৮৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল গঠনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে আগত প্রায় ৮ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং রোহিঙ্গাদের উদারভাবে আশ্রয়প্রদানকারী প্রায় ৪ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণের চাহিদা পূরণ করা হবে।
২০১৯ সালের জেআরপি-তে ৯২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিলের আবেদন করা হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে ৭০ শতাংশের কিছু বেশি বা ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগৃহীত হয়েছিল।
সামগ্রিকভাবে মোট আপিলের প্রায় ৫৫ শতাংশই প্রয়োজন হবে খাদ্য, আশ্রয়ন, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা প্রদানের জন্য। আর শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মোট তহবিলের প্রায় ২৯ শতাংশ ব্যয় হবে। এছাড়াও স্থানীয় বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা, জ্বালানী এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যক্রমগুলো অব্যহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
জেনেভা থেকে পাওয়ার এক বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এবং এ দেশের জনগণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে ব্যাপক সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা ও চলমান সংকটে স্থানীয় অর্থনীতির শক্তিশালীকরণ জরুরি।
২০১৭ সাথে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য ২০২০ সালটি নির্বাসনের তৃতীয় বছর। রোহিঙ্গারা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে, তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চান; তবে তা নির্ভর করছে তাদের এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার লাভের সুযোগ এবং মিয়ানমারে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির নিশ্চয়তার ওপর।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার ফিলিপো গ্র্যাণ্ডি বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২০ সালের এই জেআরপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তাদের বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান এবং ভবিষ্যতে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন উভয়ের জন্য। ততদিন পর্যন্ত অবশ্যই বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের পাশাপশি তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ সরকার এবং এদেশের জনগণের পাশে থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন।’
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাহিদা মেটাতে ও জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২০ এর জেআরপি-তে সেই ইস্যুগুলোকে অধিকতর গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, যেসব কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের জন্য সেবামূলক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, টেকসই জীবিকার সুযোগ, জ্বালানি বিষয়ক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ পুনর্গঠনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর মহাপরিচালক আন্তোনিও ভিতোরিনো বলেন, ‘২০১৭ সালের আগস্টে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকট মোকাবিলায় কাজ শুরু করে, তখন থেকে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি শরণার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে সরকারের সাথে কাজ করার জন্য এবং স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থপূর্ণ সহায়তা প্রদানের জন্য। ২০২০ সালের জেআরপি’র কেন্দ্রে থাকবে অবকাঠামো, জীবিকা, সুরক্ষা ও পরিবেশ; আর এটি আমাদের আগের কাজেরই চলমান প্রয়াস।’
জেআরপি’র কৌশলগত উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে শরণার্থী নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জীবন-রক্ষায় প্রয়োজনীয় জরুরি সহায়তা প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং মিয়ানমারে সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান তৈরিতে কাজ করা। এই উদ্দেশ্যগুলো দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত অনুমতি দেয় রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের। জেআরপি-২০২০ এর মাধ্যমে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শিক্ষা প্রদান করতে পারবে। শিগগিরই ৬ষ্ঠ থকে ৯ম শ্রেণির ১০ হাজার শিশুকে নিয়ে একটি পাইলট কার্যক্রম শুরু হবে, যার ভবিষ্যৎ বর্ধিতকরণ নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী মা-বাবা এবং শিশুরা সকলেই মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমে শিক্ষার সুযোগ চেয়েছিলেন। তাদের দৃষ্টিতে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পর সামাজিক পুনর্বাসনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের অর্জন ও শিক্ষাগুলোকে জেআরপি-২০২০ এর মাধ্যমে সরকার এবং মানবিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো আরও কার্যকর করে তুলবে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছিল। উন্নত রাস্তা, পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা, ব্রিজ ও পাহাড়ের ঢাল সংরক্ষণের ফলে ক্যাম্পগুলো এখন আগের তুলনায় বেশি নিরাপদ। তিন হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের প্রথম দিন থেকেই মানবিক কার্যক্রমের অগ্রগতি ও অর্জনসমূহ লক্ষণীয়। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যতদিন না স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদা সহকারে তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের জন্য সুদৃঢ় বৈশ্বিক সংহতি এবং তহবিল অপরিহার্য; যাতে শরণার্থী এবং বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখা যায়।