বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই রাজধানী শহরে সাম্প্রতিক অতীতে কয়েক বছর তথা কয়েক মাসের মধ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যাতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চকবাজার, বনানীর এফআর টাওয়ার এবং গুলশানের ডিএনসিসি’র কাঁচাবাজারের আগুন প্রমাণ করে রাজধানীবাসী কতটা ঝুঁকিতে জীবনযাপন করছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্মান বিধি না মানা, অবহেলা, গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে বলে বার্তা সংস্থা ইউএনবির সাথে আলাপচারিতায় উল্লেখ করেছেন খ্যাতনামা নির্মাণ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী।
পোশাক কারখানার মতো রাজধানীর ভবনগুলোতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এ বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন এবং গত বৃহস্পতিবারে বনানীর এফআর টাওয়ার ভবনের অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয়।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এফআর টাওয়ার ভবনটি নির্মাণ বিধি মেনে তৈরি হয়নি এবং ভবনের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলোও ব্যবহার অনুপযোগী ছিল।
‘এতে আশ্চর্যের কিছু নেই!’ উল্লেখ করে অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ঢাকার অধিকাংশ সুইচ্চ ভবনগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই।’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, গ্যাসসহ অন্যান্য অগ্নিসহায়ক যেমন- সিগারেট, গ্যাস সিলিন্ডার ও প্রযুক্তিগত ডিভাইস এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দাহ্য পদার্থগুলোই মূলত অগ্নিকাণ্ডের কারণ।
তবে বনানীর অগ্নিকাণ্ড কিভাবে হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আশঙ্কা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।
‘ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে’
‘ঢাকার অধিকাংশ ভবনগুলো নির্মাণ বিধি ও ১৯৯৬ সালের ইমরাত নির্মাণ আইন অমান্য করে তৈরি হয়েছে’ বলে মনে করেন নির্মাণ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রাজধানীতে এতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে যে, শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হলে এক লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। এরপরও ভূমিকম্পের প্রস্তুতিতে দেশে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
রাজধানীর ৮০ শতাংশ ভবন রাজউকের অনুমোদন ছাড়া হয়েছে উল্লেখ করে আরেক বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, অন্য ভবনগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ ভবন নকশার বরখেলাপ ও নিয়ম লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে।
ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই অধিকাংশ ভবন তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তাই পুরো ঢাকা শহর ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশিরভাগ ভবন ও স্থাপনাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ছাড়াই নির্মিত হয়েছে।
২০১১ সালে রাজধানীর ৫৩টি ভবনের ওপর করা একটি জরিপ তুলে ধরে অধ্যাপক আনসারী বলেন, সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
‘প্ল্যান-বি’
অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সরকারকে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। যারা নিরাপত্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে।
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, রাজউকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এজেন্সিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। যাতে করে তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ বন্ধ করার পাশাপাশি পুরাতন ঝুঁকিপূর্ণভবনগুলো অপসারণ করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি কথা স্মরণ করে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, ওই দুর্ঘটনার পরে বিদেশি ক্রেতাদের চাপের মুখে প্রায় ৮০০টি কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অ্যাকর্ডের মতো এখানেও একটি কমিটি প্রয়োজন, যোগ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পরে দুটি পশ্চিমা ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড ও অ্যাল্যায়েন্সের চাপের মুখে বেশিরভাগ কারখানায় মালিকরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সুউচ্চ ভবনগুলোতে নিরাপত্তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তদারকির জন্য একটি কমিটি তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক আনসারী বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কঠোরভাবে নির্মাণ বিধি মানা-যেখানে কিভাবে একটি নিরাপদ সুউচ্চ ভবন নির্মাণ সম্ভব বলা আছে।
তবে সুউচ্চ না হলেও অন্যান্য ভবনগুলোর প্রত্যেকটি তলায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, বিপদে ব্যবহারের জন্য এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
‘বেশিরভাগ সময় আমরা দেখতে পাই বাড়ির মালিকরা প্রধান দরজা ও ছাদের দরজা তালা মেরে রেখে দেয়, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি তলার ভাড়াটে বা সংশ্লিষ্টদের কাছে চাবি দিয়ে রাখতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।