ঘড়ির কাটায় দুপুর ২টা বেজে ৩৩ মিনিট। এমন সময় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেউ সেখানে নেই। শ্রেণিকক্ষে ঝুলছে তালা। শিক্ষকদের কক্ষ খালি। কেবল পরিছন্নতাকর্মী পতাকা নামাচ্ছেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হাসিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রবিবার (৪ মে) গিয়ে এমন চিত্রের দেখা মেলে। অথচ বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার কথা বিকাল ৪টায়। অবস্থিত।

জানতে চাইলে পরিছন্নতাকর্মী অলোক বিশ্বাস বলেন, ‘আজ (রবিবার) ২টার দিকে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে চলে গেছেন। এসএসসি পরীক্ষার কারণে প্রতিদিন ১টার মধ্যেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়।’

অফিস সহায়ক আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে ৩৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। তার মধ্যে আজ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। তবে ছুটির বিষয়ে হেড স্যারের (প্রধান শিক্ষক) সঙ্গে কথা বলেন।’

শিক্ষার্থী ও অভিভাবক থেকে শুরু করে এলাকাবাসীর অভিযোগ, অন্যান্য বিদ্যালয় প্রতিদিন ১০টায় শুরু হয়ে চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এসে ক্লাসে না নিয়ে অফিসে বসে থাকেন। দুপুর একটা বাজলেই ছুটি দিয়ে চলে যান যে যার মতো। এটি এ বিদ্যালয়ের নিত্যদিনের চিত্র।

অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, ‘আজকে (রবিবার) শুধু ইংরেজি ক্লাসের পর ১টার দিকে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটে। ৪টা পর্যন্ত স্কুল চললে ভাল হয়।’

‘সামনে পরীক্ষা, তবুও অন্যান্য ক্লাস ঠিকমতো হয় না। পড়াশোনা নিয়ে তাই আমার চিন্তা হয়।’

অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, ‘প্রতিদিনই ১২ টা থেকে ১ টার মধ্যে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। আবার অনেকদিন সাড়ে ১০ টার দিকে নাম ডেকেই ছুটি দিয়ে দেয়।’

অভিভাবক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার তিন ছেলে এই স্কুলে পড়েছে। ছোট ছেলে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সে প্রতিদিন সকাল ১০টায় স্কুলে গেলেও দুপুর ১টার মধ্যে বাড়ি চলে যায়। জানতে চাইলে সে বলে, এই স্কুলে আর আগের মতো পড়া হয় না।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা সবাই দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। (বর্তমান) সব শিক্ষককে সাসপেন্ড করে নতুন শিক্ষক আনা দরকার।’

বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩০ গজ দুরে ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের দোকান। তার মেয়ে বিথি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আব্দুর রহিম বলেন একই কথা।

‘প্রতিদিন একটা বাজলেই ছুটি হয়ে যায় স্কুল। এসব দেখার কেউ নাই। বিদ্যালয়টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।’

আরও পড়ুন: বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা স্থাপনের অনুমতি দিতে গাইডলাইন হচ্ছে

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির অভিভাবক সদস্য হাসানুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘১টা বাজলেই বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুটিকয়েক সহকারী শিক্ষককে নিয়ে বিদ্যালয়ের বইখাতা বিক্রি, নিয়োগ বাণিজ্য, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া, রশিদ বাদে লেনদেনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে তাকে কিছু বলা যায় না। কিছু বলতে গেলেই যাচ্ছেতাই আচরণ করেন। আমি শীঘ্রই ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করব।’

বিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত সহকারী শিক্ষক আবু খোকনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তিনি কম্পিউটারে কাজ করছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই একটার দিকে বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যায়। ছুটি দেওয়ার বিষয়টি প্রধান শিক্ষকের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’

এরপর প্রধান শিক্ষক মো. নুর উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হয়। এসএসসি পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রতিদিন বিদ্যালয় ছুটি দেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।

প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সম্প্রতি বোর্ড থেকে বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটি পরিবর্তন করেছে। সেই ক্ষোভে সভাপতি ( সাবেক) জিলাল উদ্দিনের ভাই শহিদুলসহ কয়েকজন বিদ্যালয়ে ঢুকে দুজন শিক্ষককে মারধর করেছেন। সেজন্য বিদ্যালয় ছুটি দিয়েছি। এসব নিয়ে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলার পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’ বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।

আরও পড়ুন: ঝিনাইদহে যে গ্রামে ৬ দশক ধরে তৈরি হয়ে আসছে আখের গুড়

তবে প্রধান শিক্ষকের করা অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক সভাপতি ভাই শহিদুল বলেন, ‘কাউকে মারধর করা হয়নি। শুধু কমিটি বদলের কাগজ চাইতে গিয়েছিলাম।’

এদিকে, বিকাল ৪টার আগে বিদ্যালয় ছুটি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই বলে জানিয়েছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাজমুল হক। তিনি বলেন, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্ত করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।’