তারা মনে করেন, একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠন এবং টিকা সংগ্রহের আগে প্রয়োজনীয় কাজটি করার জন্য দ্রুত সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা এবং নীতিমালা তৈরি করা দরকার।
আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন: বাংলাদেশের কাছে ‘বিকল্প কম’
বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বিদ্যমান কোল্ড চেইনের (শীতল সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা) সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন যাতে টিকাটি সুষ্ঠু বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়।
টিকা নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ইউএনবির সাথে আলাপকালে সরকার গঠিত আট বিভাগের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য বাংলাদেশকে আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ দল এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা ও নীতিমালা তৈরি করছে।’
ডা. ফয়সাল বলেন, ‘এটি নিশ্চিত যে যত পরিমাণ ডোজই আসুক না কেন সরকার একসাথে দেশের সব মানুষকে টিকা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে না। এ কারণেই বিশৃঙ্খলা ও ভুল ব্যবহার এড়াতে আমাদের একটি অগ্রাধিকারের তালিকা এবং টিকা নীতি দরকার।’
তিনি বলেন, অবিলম্বে একটি টিকা বিতরণ নীতিমালা তৈরি এবং জনগণকে এ বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন।
‘সরকারকে অবশ্যই জনগণের সাথে যোগাযোগ করতে এবং যথাযথ তথ্য প্রদান করে তাদের সামনে প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপন করে বাস্তবতা মেনে নিতে তাদের প্রস্তুত করতে হবে,’ বলেন তিনি।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, অন্যথায় কিছু টিকার ডোজ দেশে এলে মানুষ হাসপাতাল ও টিকা বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং সে সময়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। ‘তাই আমাদের আগে থেকেই মানুষকে জানাতে হবে যে এটি প্রথম এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কারা পেতে পারেন।’
কোল্ড চেইন প্রস্তুত করা হচ্ছে
ডা. ফয়সাল বলেন, ‘কোল্ড চেইনে সাশ্রয়ী এবং সংরক্ষণযোগ্য এমন একটি টিকা বাংলাদেশের সংগ্রহ করা দরকার। তাই আমাদের অবশ্যই টিকা সংরক্ষণের জন্য একটি পরিকল্পনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশের বর্তমান টিকার কোল্ড চেইনের একটি বড় অংশ ‘হাম-রুবেলা’ (এমআর) টিকায় ব্যবহার করা হয়।
গত মার্চে ৯ মাস থেকে ১০ বছরের কম বয়সী মোট তিন কোটি ৪০ লাখ শিশুকে এমআর টিকা দেয়ার কথা ছিল। তবে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে এ ক্যাম্প স্থগিত ছিল।
ডা. ফয়সাল বলেন, ‘আমরা যদি শিশুদের এ টিকা দিয়ে কোল্ড চেইনটি খালি করতে না পারি তবে নতুন টিকা কোথায় রাখব? সুতরাং, টিকার গুণগত মান বজায় রাখার জন্য আমাদের একটি পরিকল্পনা নেয়া দরকার।’
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ চৌধুরী (লেলিন) বলেন, একসাথে করোনা টিকার তিন কোটি ডোজ সংরক্ষণের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমাদের বিদ্যমান কোল্ড চেইনে টিকার কতগুলো ডোজ সংরক্ষণ করা যায় তা মূল্যায়ন করা উচিত। তারপর আমরা আমাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যক্তিগত কোল্ড স্টোরগুলো ভাড়া নিতে পারি। টিকা পাঠাতে হবে বলে আমরা বিভিন্ন জেলায় অস্থায়ী স্টোরেজ তৈরির পদক্ষেপ নিতে পারি।’
আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু
মনিটরিং টিম দরকার
ডা. ফয়সাল বলেন, ডোজগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ, পরিবহন, বিতরণ এবং না দেয়া হলে এর গুণগত মান হ্রাস পাবে। ‘এ জন্য আমাদের একটি মনিটরিং টিম দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমরা টিকার ডোজ সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করব। গুণগত মান বজায় রাখতে আমাদের এটি অবশ্যই সঠিকভাবে করা উচিত। টিকাটি সঠিকভাবে পরিবহন এবং সঠিক তাপমাত্রা বজায় রেখে সর্বত্র সংরক্ষণ করা হবে কি না পর্যবেক্ষণকারী দল তা পর্যবেক্ষণ করবে।’
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, যেহেতু বাংলাদেশে কোনো টিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি সেহেতু লোকদের ওপর টিকার কোনো প্রতিক্রিয়া বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না তাও এ দলটি খতিয়ে দেখবে।
উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন
ডা. লেনিন বলেন, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ‘শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দ্বারা এটি করা সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘একটি টিকা নীতিমালা তৈরি করা এবং এর বাস্তবায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যুক্তরাজ্য সেই কাজটি করার জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ করেছে। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং এর বিভিন্ন সংস্থা যারা পর্যাপ্ত পরীক্ষা, চুক্তি, ট্রেসিং, জনগণকে মাস্ক পরতে এবং স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা নিশ্চিত করতে পারেনি, তারা একটি টিকা নীতি এবং পরিকল্পনা তৈরি করছে, সেটায় কীভাবে আমরা তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারি?’
ডা. লেনিন বলেন যে বাংলাদেশে আসার পরে টিকা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা একটি কঠিন কাজ হবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে ক্ষমতাবানরা প্রাথমিক পর্যায়ে টিকা গ্রহণের চেষ্টা করবেন যেমনটি আমরা পিপিই এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণের সময় দেখেছি। এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি টিকা নিয়েও তৈরি করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘এ কমিটিকে টিকা নির্বাচন, তা কিনতে তহবিল সংগ্রহ ও অন্যান্য যৌক্তিক সহায়তা এবং অনিয়ম রোধ করে সঠিকভাবে টিকা পরীক্ষা, সংরক্ষণ ও বিতরণ সম্পর্কিত অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
আরও পড়ুন:করোনার ভ্যাকসিন নেবেন জাতিসংঘ প্রধান
চীন ও রাশিয়ার টিকাগুলো এড়ানো যায় না
ডা. লেনিন বলেন, অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হওয়ায় বাংলাদেশ কার্যকর কোভিড টিকা সংগ্রহ করতে অসুবিধার মুখোমুখি হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় এ টিকাটি কখন অনুমোদন পেতে পারে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, সংরক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকা দুটি দেশের জন্য অনুপযুক্ত।’
লেনিন বলেন, এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও চীন এবং অন্যদের থেকে টিকা পেতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘চীন এবং রাশিয়া স্থানীয়ভাবে তাদের টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে। তবে আমাদের মিডিয়া এ দুটি দেশের টিকা নিয়ে খুব একটা রিপোর্ট করে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রাশিয়া ও চীনের টিকাগুলো পাওয়ার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
ডা. বে-নজীর বলেন, চীন ও রাশিয়ার টিকাগুলোর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এগুলো প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বেশ কার্যকর।
‘চীন ও রাশিয়ার সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিলে আমরা তাদের টিকাগুলো পেতে পারি,’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ফাইজারের ভ্যাকসিন অনুমোদন দিল কানাডা