ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত খরাসহ বছর জুড়ে বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ ও চলমান করোনা মহামারির কারণে চিংড়ির দরপতন অব্যাহত রয়েছে। লোকসানের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আবারও ক্ষতির মুখে পড়ছেন চিংড়ি চাষিরা।
অতি সম্প্রতি অতিরিক্ত বৃষ্টি ও অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিতে বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার চিংড়ি ঘের পানিতে ডুবে গেছে। ভেসে গেছে চিংড়িসহ কয়েক কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং বুলবুলের আঘাতেও কয়েক হাজার মৎস্য ঘেরের চিংড়ি ভেসে গেছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি, আম্ফান ও বুলবুল প্রভাবে বাগেরহাট জেলায় ১৯ হাজার ৩০১টি মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ২৩ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তবে চাষিদের দাবি ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েকগুন বেশি।
বাগেরহাট জেলার রামপাল এবং চিতলমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পানির চাপে মৎস্য ঘেরের ভেড়ি ভেঙে অন্য ঘেরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কিছু কিছু ঘের থেকে পানি নেমে গেলেও ভেঙে যাওয়া বেড়ি মাটি দিয়ে পাড় উচু করার কাজ করছেন অনেকে।
ভাটার সময় পানি কমতে শুরু করলেও প্রবাহমান খালে পাটা দিয়ে ও জাল পেতে মাছ চাষ করার কারণে পানি চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে মানুষের বাড়িঘর এবং ফসলি জমি থেকে পানি নামতে দেরি হচ্ছে। তাই এসব খালে থাকা বাঁধ দ্রুত অপসারণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও অস্বাভাবিক জোয়ারে মৎস্য ঘেরে পানি ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় ঘেরের দেড় থেকে দুই ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। পানির চাপে ঘেরের ভেড়ি ভেঙে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে।
রামপালের চিংড়ি চাষি আব্দুল ওহাব জানান, ৩৫ একর জমিতে তার চিংড়ি ঘের রয়েছে। তিন দশক ধরে তিনি মৎস্য ঘের ব্যবসা করে আসছেন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত পানি, খরা, ভাইরাসসহ নানা কারণে একের পর এক চিংড়ি চাষে লোকসান হচ্ছে। আম্ফান, বুলবুল এবং সর্বশেষ অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘের ডুবে মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া করোনার কারণে চিংড়ির মূল্য কমে গেছে। সেই সাথে বাজারে চিংড়ির ক্রেতাও নেই।
মৎস্য চাষি ইউসুফ শেখ জানান, তার ১৬ বিঘার মৎস্যঘের ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। ঘেরের ভেড়ি ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। ঘেরের ওপর প্রায় দুই ফুট পানি ছিল। ৯ মাসের ব্যবধানে তিনবার ঘের ডুবে মাছ ভেসে গেছে। প্রতিবার বিপর্যয়ের পর তারা নতুন উদ্যোমে ঘের তৈরি করে আবার মাছ চাষ করেন। কিন্তু একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কারণে মৎস্য চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন এ চাষি।
চিতলমারী উপজেলার চরলাটিমা গ্রামের চাষি বিজন হীরা, অনিল মন্ডল, রথিন্দ্র নাথ মন্ডলসহ বেশ কয়েকজন চাষির সাথে কথা হলে তারা জানান, তাদের ঘেরের ওপর দিয়ে এখনো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। দেখলে বুঝার উপায় নেই কোনটা কার ঘের। এসব ঘের থেকে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। মৎস্য চাষ করেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু মাছ ভেসে যাওয়ায় তারা এখন দুচিন্তায় পড়ে গেছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়েছেন মৎস্য চাষিরা।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, সর্বেশেষ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বাগেরহাট জেলায় ৬ হাজার ৮৫৩টি মৎস্য ঘের ডুবে গিয়ে ১৪ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত মে মাসে আম্ফানের সময় পাঁচ হাজার ১২৪টি মৎস্য ঘের ডুবে পাঁচ কোটি ৭১ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে সাত হাজার ৩২৪টি মৎস্য ঘের ডুবে গিয়ে তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক জানান, মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় তিন দফায় ১৯ হাজার ৩০১টি মৎস্যঘের পানিতে ডুবে গেছে। এতে প্রায় প্রায় ২৩ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত খরার কারণে পানির অক্সিজেন কমে যাওয়া এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘেরে চিংড়ি মারা যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা প্রণয়ন করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন জানান, চিংড়ি চাষে বিপর্যয়ের শেষ নেই। একের পর এক বিপর্যয়ের কারণে চাষিরা সর্বশান্ত হতে চলেছে। সম্প্রতি অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি এবং আম্ফান ও বুলবুলের তাণ্ডবে চিংড়ি শিল্পের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তিনবারে চিংড়ি চাষিদের শত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
চিংড়ি শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের আর্থিক সহায়তা করার দাবি জানান তিনি।
মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, বাগেরহাট জেলার ৬৮ হাজার ১৬৫ একর জমিতে মোট ৭৬ হাজার ৭৩০টি মৎস্য ঘের রয়েছে। ওই এলাকায় চিংড়ি চাষের সাথে ৬৫ হাজার ৮০৪ জন জড়িত রয়েছেন।