অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) শেষ নাগাদ অর্থনীতিকে কোভিড-১৯-পূর্ব প্রবৃদ্ধির গতিতে ফিরিয়ে আনার আশা করছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগের ম্যাক্রোইকোনমি উইং প্রণীত 'মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে ২০২৩-২৪ থেকে ২০২৫-২৬'-এ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালে মহামারি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গত তিন বছরের বড় অংশের জন্য অর্থনীতি তার দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধির গতিপথ থেকে ছিটকে পড়েছিল। উহানে প্রাদুর্ভাবের তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক জিডিপি ডেটা (আইএমএফ নির্ধারিত শর্ত অনুসারে) এটি প্রমাণ করে। এতে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন ২০২০) অর্থনীতি ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, কারণ ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আরও পড়ুন: দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণমান নেতিবাচকে নামাল ফিচ
গত মাসে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত আংশিক ত্রৈমাসিক তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ শতাংশ। চতুর্থ ত্রৈমাসিকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির (সংকোচন) কারণে অর্থনীতি কতটা ছিটকে পড়েছিল তা এটিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
কোভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট মন্দা আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম ৬ মাসের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাকে হতাশাজনক করে তুলে। এটি তৃতীয় তিন মাসেও (জানুয়ারি থেকে মার্চ,২০২১) পুনরুদ্ধারের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
২০২১-২২ অর্থবছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি সফল টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং লকডাউন বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রস্তুত বলে মনে হয়েছিল। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ, ২০২২) জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে।
তবুও যখন পুনরুদ্ধারের কাজ চলছিল, তখন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে হোঁচট খাওয়া শুরু হয়। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে অস্থিতিশীলতা এবং সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ার ফলে কোভিড পরবর্তী দেশের পুনরুদ্ধারের গতি আবারও হ্রাস পায়।
যদিও কোভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট সংকোচনের মতো কিছুই ছিল না, তবুও ২০২২ অর্থবছরের শেষ ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি মারাত্মক মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল, যা আগের ত্রৈমাসিকের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ থেকে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশও তার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে প্রস্তুত। তবে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময়ও বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ নাগাদ কোভিড-১৯-পূর্ব প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: বাংলদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার, যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকলে এবং তা ধরে রাখতে পারলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আবারও ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পরিকল্পিত প্রবৃদ্ধি থেকে প্রকৃত বিচ্যুতি সামান্য রয়ে গেছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।
ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মূলধন সংগ্রহ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি এবং তাই সরকার তার লক্ষ্য পূরণের জন্য সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৩২ শতাংশ, যেখানে বেসরকারি ও সরকারি খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিনিয়োগের মাত্রা আরও বাড়াতে হবে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি বিনিয়োগের বাস্তবায়নের হার বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে পারলে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিনিয়োগ অর্জন করা সম্ভব।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বিষয়টি চিহ্নিত করে প্রকল্পের নকশা ও বাস্তবায়ন উভয় স্তরেই কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।’
অর্থ বিভাগের নথিতে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। রাশিয়া বিশ্বব্যাপী জ্বালানির একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ। তাই যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন পণ্যের দাম দ্রুত বেড়েছিল।
প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশও এ সমস্যায় ভুগতে পড়ে যায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে এবং ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম ইতোমধ্যেই কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতিগত হার বাড়িয়েছে এবং এর কারণে আশা করা হচ্ছে যে আগামী মাসগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসবে।
আরও পড়ুন: অর্থনীতিকে করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফেরাতে চায় সরকার
আইএমএফ অনুমান করেছে, গৃহীত পদক্ষেপগুলো মাঝারি মেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করতে সরকারগুলোকে সহায়তা করবে। অর্থ বিভাগ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৩-২৪ সালে গড় মুদ্রাস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশে নেমে আসবে। যদিও প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) এর কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও দরিদ্রদের আয় সুরক্ষায় সরকার ধীরে ধীরে মুদ্রানীতি কঠোর করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছে।
নথিতে বলা হয়েছে, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এটি মাথায় রেখে সরকার ভর্তুকি ও প্রণোদনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করেছে।
কৃষি খাতকে সহায়তা করতে এ খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ানো হয়েছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে গত অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে কৃষিঋণ ও অকৃষি পল্লি ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি।
সরকারের সহায়ক নীতির সহায়তায় শিল্প উৎপাদনের সাধারণ সূচক (মাঝারি এবং বৃহৎ আকারের উৎপাদন) বাড়ছে, যা সম্প্রসারিত শিল্প উৎপাদনকে প্রতিফলিত করে।
আরও পড়ুন: শিগগিরই এসক্রো বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পাবলিক পলিসি বিশ্লেষক ড. মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, বেশ কয়েকটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় চলতি অর্থবছরের মধ্যে কোভিড পূর্ব প্রবৃদ্ধির গতি ফিরে পাওয়া খুব চ্যালেঞ্জিং হবে।
ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে, তিনি সরকারকে প্রথমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার দিকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে আরও টেকসই করে তুলবে।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা/ডলারের তীব্র সংকট প্রতিরোধ, এলসি খোলা ও দেশীয় মুদ্রা টাকার ওঠানামার বিষয়টি আগে সমাধান করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন ড. রিয়াজ।
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিকে কোভিড-পূর্ব প্রবৃদ্ধির হারে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা উচিত, যা স্বল্প সময়ের মধ্যে খুব চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন হবে।
ড. রিয়াজ আরও বলেন, 'প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ না করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার সময় এসেছে। দীর্ঘমেয়াদে নন-পারফর্মিং লোনের উচ্চ হার কমানো, মুদ্রাস্ফীতি যৌক্তিক সীমার মধ্যে রাখা এবং বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ২০২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাল বিশ্বব্যাংক