তারা বলেছেন, মাস্ক না পরা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মগুলো মানতে জনগণের উদাসীনতা, ‘অত্যন্ত সংক্রামিত যুক্তরাজ্যের নতুন ধরন’ এবং স্বল্প সংক্রমণ হারের কারণে আত্মতৃপ্তি কোভিড-১৯ বাড়ার পেছনে মূল কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে স্বাস্থ্য সতর্কতা অবলম্বন করতে উৎসাহ প্রদান, অপ্রয়োজনীয় জনসমাবেশ এড়াতে সরকারকে গণ-প্রচারণা বাড়াতে হবে এবং শতভাগ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা উচিত।
গত ১৮ জানুয়ারি ভাইরাস সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এমনকি এটি ৩ শতাংশের নিচেও নেমে এসেছিল। তবে, সোমবার সংক্রমণের হার বেড়ে ৯.৪৮ শতাংশ হয়েছে।
বুধবার সংক্রমণের হার ছিল ৫.৯৮ শতাংশ, বৃহস্পতিবার ৫.৮২ শতাংশ, শুক্র ও শনিবার যথাক্রমে এ হার ছিল ৬.৬২ ও ৬.২৬ শতাংশ। রবিবার সংক্রমণের হার ছিল ৭.১৫ শতাংশ।
বুধবারের আগে প্রতিদিন করোনা শনাক্ত এক হাজারেরও নিচে ছিল। সোমবার আগের ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৭৭৩ জনের শরীরে নতুন করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আগামী দুই সপ্তাহ গুরুত্বপূর্ণ
ইউএনবির সাথে আলাপকালে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হসপিটালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান এম এইচ চৌধুরী (লেনিন) বলেছেন, কোভিড সংক্রমণ ফের বাড়ছে যা উদ্বেগের বিষয়।
‘করোনার সংক্রমণ নতুন করে বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে আগামী দিনগুলোতে দেশ একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। যদি ভাইরাসগুলোর ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা পরবর্তী দুই সপ্তাহ অব্যাহত থাকে, তবে আমরা এটিকে কোভিড-১৯ এর একটি নতুন ঢেউ বলব,’ বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ জানান, দীর্ঘ সময়ের জন্য স্বল্প সংক্রমণের হার মানুষকে এমন ধারণা দিয়েছে যে এই মারাত্মক রোগটি খুব শিগগিরই নির্মূল হচ্ছে।
এছাড়াও লেনিন বলেছেন, অনেকেই ভাবছেন যে গণটিকা দেয়ার কার্যক্রম চলছে তাই ধীরে ধীরে ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
‘এজন্যই মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রোটোকলগুলোকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলেছে। তারা মাস্ক পরেনি, শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখে না। জনগণ পর্যটন স্পটগুলোতেও যাচ্ছে এবং জনসমাবেশে যোগ দিচ্ছে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজগুলোও যথারীতি চলছে, যা ভাইরাসের সংক্রমণের হারকে বৃদ্ধি করছে,’ বলেন তিনি।
লেনিন বলেন, যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনের করোনাভাইরাস জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সনাক্ত হয়েছিল। ‘গত দু'মাস ধরে এটি প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় সম্ভবত এখন এই রূপটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের তিনটি ধরন ছাড়াও ভারতে গত মাসে দুটি উচ্চতর মিউট্যান্ট ভাইরাসের ধরন- এন ৪৪০ কে এবং ই ৪৮৪ কিউ সনাক্ত হয়েছে। ‘এই ধরন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
প্রতিরোধের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা
লেনিন বলেছেন, ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাসহ সবাইকে ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। ‘জনগণকে মাস্ক পরতে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি বজায় রাখতে উত্সাহিত করার জন্য সরকারের উচিত একটি প্রচারণা চালানো।’
তিনি বলেন, সরকারকে এখন অবিলম্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা উচিত যাতে মানুষ মাস্ক পরতে বাধ্য হয়।
এছাড়াও বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সরকারের উচিত তদারকি বাড়ানো যাতে সরকারি ও বেসরকারি সকল অফিসের শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
তিনি সরকারকে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ এর প্রচার আরও তীব্র করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ভ্যাকসিন কর্মসূচি জোরদার করা
লেনিন বলেন, জনগণ এখন ধীরে ধীরে এই ভ্যাকসিন গ্রহণে কম আগ্রহ দেখাচ্ছে। ‘এই ভ্যাকসিন গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই অভিযান আরও জোরদার করা উচিত।’
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন গ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জনপ্রতিনিধিদের মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়া উচিত যেমনটা তারা ভোটের আগে করে থাকেন।
এছাড়া ভ্যাকসিন প্রদানের কেন্দ্র বাড়াতে বলেন তিনি। যাতে করে মানুষ সহজেই ভ্যাকসিন পেতে পারেন।
নারীরা ভ্যাকসিন নিতে কম আগ্রহী
লেনিন বলেন, সরকার এখনও ভাসমান মানুষ, বস্তিবাসী, দিনমজুর, কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘এই গ্রুপের জন্য আমাদের দ্রুত ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, নারীদের একটি বড় অংশ এখনও করোনার ভ্যাকসিন নেয়নি। ‘নারীরা করোনার ভ্যাকসিন নিতে কম আগ্রহ দেখাচ্ছে।’
নারীদের ভ্যাকসিন নিতে উতসাহ দিতে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
ডিজিএইচএসের প্রাক্তন পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেছেন, দেশে কোনো গবেষণা ও জরিপ না থাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। ‘তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে দেশে যুক্তরাজ্যের নতুন ধরন সনাক্ত হয়েছে এবং এটি অবশ্যই ধীরে ধীরে নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে কারণ।’
বিশেষজ্ঞ আরও বলেন যে, গ্রীষ্মকাল করোনাভাইরাসের অনুকূল হতে পারে কারণ গত বছর একই সময়কালে করোনাভাইরাস বৃদ্ধি পেয়েছিল।
‘বিশেষজ্ঞদের একটি আশঙ্কা ছিল যে শীতকালে ভাইরাসটি দেশে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তবে তা হয়নি। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন অবস্থা উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য একটি গবেষণা করা উচিত।’
মৃত্যুহার কম রাখায় নজর
স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ উত্থানের পেছনে মানুষের অসতর্কতা প্রধান কারণ, তবে এটি গত বছরের মতো দীর্ঘকাল ধরে চলবে না। ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ নতুন করে বেড়ে যাওয়া নিয়ে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েছি, তবে আমরা আশাবাদী যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সংক্রমণ আবার যথেষ্ট হ্রাস পাবে,’ তিনি বলেন।
মান্নান বলেন, সংক্রমণের হার বাড়লেও মৃত্যুর হার এখনও খুব কম। ‘আমরা মৃত্যুর হার কম রাখার জন্য কাজ করছি।’
তিনি বলেন, তারা মাস্ক পরা এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য জনগণকে উত্সাহিত করতে তাদের গণ-প্রচারণা তীব্র করতে চলেছেন।