মূলত নির্মাণ কাজ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়ানো ধুলা এবং গাড়ি ও ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিবেশমন্ত্রীও বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে ৫৮ ভাগ বায়ুদূষণ হয় ইটভাটার জন্য। বর্তমানে (প্রচলিত) ইটভাটা বন্ধের জন্য পরিকল্পনা ও আইন পাস করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ইট বানানোর জন্য কাজ করছি।’
তিনি জানান, ভাটায় ইট পুড়ানো ২০২৫ সালের মধ্যে বন্ধ এবং সরকারি প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণে ঢালাই ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
মন্ত্রী বলেন, সব ইটভাটায় আপাতত পোড়া ইটের সাথে ১০ শতাংশ ব্লক বা ঢালাই ইট তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ১০০ ভাগ ব্লক ইট তৈরি করতে হবে। ধীরে ধীরে বেসরকারি প্রকল্পেও এ ধরনের ইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে।
তিনি জানান, দেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে গত বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্ব ব্যাংক। তাতে দেখা যায় যে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণ কাজ।
নির্মাণ কাজের সামগ্রী ঢেকে না রাখায় ধুলার কণা রাজধানীর বায়ুদূষণ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে শাহাব উদ্দিন এ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, ‘ঢাকাসহ বড় বড় জেলা শহরে বায়ুর মান নিরূপণের জন্য ১৬টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।’
‘ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠমো নির্মাণ এবং বিভিন্ন কাজে সমন্বয় করা প্রয়োজন। পরিষেবা কাজের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এলিভেটেট এক্সপ্রেস ও হাইওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, মেট্রোরেল নির্মাণের সময় যাতে পরিবেশ রক্ষা করা হয় সে জন্য তারা প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। সেই সাথে তারা ধুলা উড়া বন্ধে পানি ছিটানো এবং নির্মাণ সামগ্রী ও এলাকা ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
‘নগরীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না তা সরকার নজরদারি করছে,’ বলেন তিনি।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের এ দেশীয় পরিচালক রাকিবুল আমিনের বরাত দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বায়ুদূষণ মোকাবিলায় প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। তারপর এ দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে সে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে।’
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে ১৩ জানুয়ারি ৯ দফা নির্দেশনা দেয়।
নির্দেশনাগুলোর মাঝে আছে- ঢাকা শহরের মধ্যে যেসব ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনে বালু বা মাটি পরিবহন করা হয় সেগুলোতে ঢাকনা যুক্ত করা, যেসব জায়গায় নির্মাণ কাজ চলে সেসব স্থানে ঠিকাদারদের ঢাকনা দিয়ে নির্মাণ কাজ পরিচালনা, সড়কগুলোতে পানি ছিটানো, সড়কের মেগা প্রজেক্ট এবং কার্পেটিংয়ের যেসব কাজ চলছে তা যেন আইন ও চুক্তির শর্ত মেনে করা হয় তা নিশ্চিত করা, কলো ধোঁয়া ত্যাগকারী গাড়ি জব্দ করা এবং সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনোমিক লাইফ নির্ধারণ ও যেসব গাড়ি পুরোনো হয়ে গেছে সেগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
সেই সাথে আদালত লাইসেন্সবিহীন ইটভাটার মধ্যে যেগুলো এখনও বন্ধ করা হয়নি সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো ও ব্যাটারি রিসাইকিলিং বন্ধ এবং মার্কেট ও দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখা এবং পরে সিটি করপোরেশনকে ওই বর্জ্য অপসারণ করার নির্দেশ দেয়।
এদিকে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ইউএনবিকে জানান, সম্প্রতি আন্তমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শহরের ধুলা পরিষ্কার করতে ২০টি রোড সুইপিং ভ্যাহিকেল ক্রয় করা হবে।
তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশনগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উত্তর সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে অনেকগুলো অভিযান চালিয়েছে বায়ুদূষণ রোধে। ধুলাবালির মাধ্যমে যাতে বায়ুদূষণ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আবার বেশি পানি ছিটালে ড্রেনে যাবে, ড্রেনে ময়লা জমবে এবং তাতে পচা গন্ধ থেকে বায়ুদূষণ হবে। সে ক্ষেত্রে এখানে চ্যালেঞ্জ আছে। কীভাবে সব এক সাথে পরিষ্কার করা যায় সেটি আমরা দেখছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক এমএ মতিন বলেন, ঢাকায় উন্নয়নমূলক কাজের খোঁড়াখুঁড়ি, ভবন নির্মাণ, ঢাকার আশপাশের ইটভাটা, ঢাকার শিল্প কারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়ার ফলে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। এটি রোধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। খোঁড়াখুঁড়ির ধুলাবালি গাড়ির মাধ্যমে বেশি উড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত গাড়ির ফলে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। বিদেশে কোনো উন্নয়নমূলক বা ভবন নির্মাণের কাজ করলে ঢেকে রাখে। তাতে বায়ুদূষণ কম হয়। সেই সাথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে কমিয়ে আনলে দূষণ কমবে। ঢাকার শিল্প কারখানা সরানো এবং আশপাশের ইটভাটাগুলো পরিবেশবান্ধব করতে হবে।
তার মতে, সরকার চাইলে বা আইন প্রয়োগ করলে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব। না হলে এটি আরও বাড়বে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন ইউএনবিকে জানান, শুষ্ক মৌসুমে যাতে ধুলাবালি উড়ে বায়ুদূষণ না করে সে জন্য ২১ নভেম্বর থেকে ঢাকার প্রধান সড়কে পানি ছিটানো হচ্ছে। আপাদত ১০ গাড়ি প্রতিদিন পানি দিচ্ছে।
‘ধুলা থেকে যে বায়ুদূষণ হয় সেটি বন্ধে আমরা রোড সুইপিং ভ্যাহিকেল নামে ৯টি গাড়ি আমদানি করব। সে জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) জমা করেছি। রোড সুইপিং ভ্যাহিকেলের নিচে ব্রাশ ও পানি থাকবে। রাস্তায় এ গাড়ি দিয়ে ধুলাবালি পরিষ্কার করা হবে,’ যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ইউএনবিকে বলেন, বায়ুদূষণে প্রচুর রোগের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে ফুসফুসে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টসহ নানাবিদ রোগ বেশি হচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসা করতে মানুষের প্রচুর টাকাও খরচ হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, খাবারের সাথে বায়ুদূষণ মিশে যাচ্ছে। ফলে কিডনি নষ্ট, ডায়রিয়া, হাঁপানি, এলার্জি ও পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে প্রতিনিয়ত ভুগছেন শত শত রোগী।