বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় থেকে উৎপন্ন রাজস্বের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সঠিক বিকল্প বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার দ্বিধায় রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো উচিত নাকি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আরও বন্ড ইস্যু করা উচিত তা নিয়ে শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বিভক্ত।’
তিনি বলেন, সরকার যদি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায়, তাহলে হয় রমজানের আগে করতে হবে বা রমজানের পরে- এই প্রশ্নগুলো প্রায় প্রতিদিনই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে।
বিপিডিবির ক্রমবর্ধমান লোকসানের বোঝা কমাতে তারা আরও বন্ড ইস্যু করার প্রভাবও বিশ্লেষণ করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা, যেখানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৬ টাকা ৭০ পয়সা দরে।
বিপিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, এর অর্থ সরকারকে প্রতি ইউনিটে ৫ দশমিক ৩ টাকার অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: জরুরি ভিত্তিতে অবৈধ বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
বিপিডিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, একক ক্রেতা হিসেবে বিপিডিবি এই অর্থবছরে মোট ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে।
এর প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৩৩ পয়সা এবং প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করতে খরচ হয়েছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা, লোকসান হয়েছে প্রায় ৪ টাকা ৬৩ পয়সা।
সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে পাইকারি শুল্ক ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। সেটি কার্যকর হয় একই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে।
এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় হয়েছে ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যার ফলে লোকসান হয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
এই বিশাল লোকসানে সরকার চরম বিপাকে পড়েছে কারণ বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। একই সময় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কেন্দ্র থেকে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রে গড়ে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ৭ টাকা ৬৩ পয়সা, স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান (আইপিপি) থেকে ১৪ টাকা ৬২ পয়সা, রেন্টাল কেন্দ্রে ১২ টাকা ৫৩ পয়সা, পাবলিক প্লান্টে ৬ টাকা ৮৫ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ ৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
সরকার বেসরকারি খাত ও ভারত থেকে ডলারে বিদ্যুৎ কেনে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সরকারের জমা হওয়া বকেয়া বিল এখন প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎ খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা) এবং বাকি ১ বিলিয়ন ডলার জ্বালানি খাতে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সংকটের ভয়াবহতার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে সংকটটা স্থানীয় মুদ্রার নয়। যেভাবেই হোক আমরা ম্যানেজ করতে পারব। তবে মূল সংকট ডলার নিয়ে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার প্রয়োজন।
এমন পরিস্থিতিতে বিপিডিবির কিছু পাওনা পরিশোধের সুবিধার্থে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বন্ড চালু করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, 'প্রাথমিকভাবে আমরা ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়েছি এবং এটি বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এজন্য সরকারকে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়াতে হবে বা আরও বন্ড চালু করতে হবে। যদি আরও বন্ড দেওয়া হয় তবে এটি ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করতে পারে।’
তবে তারা কী করবেন সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে রয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আরও ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত রপ্তানির প্রস্তাব আদানি গ্রুপের: সূত্র